রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর

Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer

রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর | Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer : রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর | Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer নিচে দেওয়া হলো। এই West Bengal WBCHSE Class 11th History Rastrer Prokriti Question and Answer, Suggestion, Notes | একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) থেকে বহুবিকল্পভিত্তিক, সংক্ষিপ্ত, অতিসংক্ষিপ্ত এবং রোচনাধর্মী প্রশ্ন উত্তর (MCQ, Very Short, Short, Descriptive Question and Answer) গুলি আগামী West Bengal Class 11th Eleven XI History Examination – পশ্চিমবঙ্গ একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস পরীক্ষার জন্য খুব ইম্পর্টেন্ট। একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস পরীক্ষা তে এই সাজেশন বা কোশ্চেন (রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর | Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer) গুলো আসার সম্ভাবনা খুব বেশি।

তোমরা যারা রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর | Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer খুঁজে চলেছ, তারা নিচে দেওয়া প্রশ্ন ও উত্তর গুলো ভালো করে পড়তে পারো।

রাজ্য (State) পশ্চিমবঙ্গ (West Bengal)
বোর্ড (Board) WBCHSE, West Bengal
শ্রেণী (Class) একাদশ শ্রেণী (WB Class 11th)
বিষয় (Subject) একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস (Class 11 History)
চতুর্থ অধ্যায় (Chapter 4 / Unit-4) রাষ্ট্রের প্রকৃতি (Rastrer Prokriti)

[Class 11 All Unit Test Question and Answer (1st 2nd) Click here]

রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর | West Bengal WBCHSE Class 11th History Rastrer Prokriti Question and Answer 

রচনাধর্মী | রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর | WB Class 11 History Rastrer Prokriti Descriptive Question and Answer:

1. রুশো ও মন্তেস্কর রাষ্ট্রদর্শন বিশ্লেষণ করো।

Ans: ভূমিকা: অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্স তথা ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ হলেন জ্যাঁ জ্যাকুইস রুশো (১৭১২-১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দ)। ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দ) প্রাক্কালে তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কিত মতবাদ ফ্রান্সে এক ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। রাষ্ট্রতত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর কালজয়ী গ্রন্থটি হল ‘সোশ্যাল কনট্রাক্ট’ (Social Contract) বা সামাজিক চুক্তি। এ ছাড়াও ‘অরিজিন – অফ ইনইক্যুয়ালিটি’ সহ আরও অন্যান্য গ্রন্থে তাঁর রাষ্ট্রদর্শনের পরিচয় পাওয়া যায়।

রুশোর রাষ্ট্রচিন্তা: রুশোর রাষ্ট্রতত্ত্বের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বা দিক হল প্রকৃতির রাজ্য (State of Nature), সামাজিক চুক্তি (Social Contract) এবং সাধারণ ইচ্ছা (General Will)।

[১] প্রকৃতির রাজ্য: রুশোর মতে, প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ ছিল স্বাধীন, সৎ ও সুখী। সেখানে মানুষদের মধ্যে এক সুমধুর সম্পর্ক ও সুখ-শান্তি ছিল বিরাজমান। কিন্তু সমাজ ও সভ্যতার শৃঙ্খলা তাকে পরাধীন করেছে। তাই মানুষ চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠনে তৎপর হয়েছে। রুশো বলেছেন-

“মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন, কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে পড়ে।” (Man is born free but everywhere he is in chains) 

[২] সামাজিক চুক্তি: ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দে রুশোর বিখ্যাত গ্রন্থ সামাজিক চুক্তি বা সোশ্যাল কনট্রাক্ট প্রকাশিত হলে সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এই চুক্তিটি গড়ে উঠেছিল সমাজের মানুষের নিজেদের মধ্যে থেকেই, অর্থাৎ প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের। সামাজিক চুক্তি অনুসারে সরকার জনগণের ইচ্ছাপূরণে দায়বদ্ধ। কিন্তু সরকার সেই দায়দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে জনগণ তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে। রুশো সামাজিক সাম্য ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রকেই আদর্শ ব্যবস্থা বলে মনে করেন।

[৩] সাধারণ ইচ্ছা: যে ইচ্ছার মধ্যে সাধারণের মঙ্গল নিহিত তারই সমন্বয়ে গড়ে ওঠে সাধারণের ইচ্ছা। রুশোর মতে, মানুষের ইচ্ছা সাধারণত দুই ধরনের-একটি হল প্রকৃত ইচ্ছা, আর অন্যটি হল বাস্তব ইচ্ছা। বুশো বলেছেন-“রাষ্ট্র হল জনসাধারণের ইচ্ছার প্রতিফলন।”

মন্তেস্কর রাষ্ট্রচিন্তা:

[১] রচিত গ্রন্থ: মন্তেস্কুর রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কিত সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত গ্রন্থটি হল দ্য স্পিরিট অফ লজ (‘The Spirit of Laws’ এ ছাড়াও দ্য পার্সিয়ান লেটারস (‘The Persian Letters’) এবং গ্রেটনেস অ্যান্ড ডেক্লাইন অফ দ্য রোমানস প্রভৃতি গ্রন্থ থেকেও তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া যায়।

[২] ক্ষমতা বিভাজন তত্ত্ব: মন্তেস্কুর রাষ্ট্রচিন্তার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ক্ষমতা বিভাজন তত্ত্ব। তিনি ‘দ্য স্পিরিট অফ লজ’ গ্রন্থে রাষ্ট্রের ক্ষমতা বিভাজন তত্ত্বটি বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর ক্ষমতা বিভাজন তত্ত্ব-এর মূলকথা হল-একই ব্যক্তি বা শাসকের হাতে শাসন, আইন এবং বিচার বিভাগের ক্ষমতা থাকা উচিত নয়। তাহলে শাসক তথা রাষ্ট্র স্বৈরাচারী হয়ে পড়বে এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা লোপ পাবে। তাই তিনি শাসন, আইন ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা বিভাজনের দাবি জানান।

[৩] স্বাধীনতার ধারণা: মন্তেঙ্কু ‘দ্য স্পিরিট অফ লজ’ গ্রন্থে স্বাধীনতার ধারণা ব্যক্ত করেছেন। তবে তিনি অনিয়ন্ত্রিত ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরোধী ছিলেন।

[৪] রাষ্ট্র সম্পর্কিত তত্ত্ব: মন্তেস্কু মূলত তিন ধরনের রাষ্ট্র বা সরকারের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে এগুলি হল- (i) রাজতন্ত্র, (ii) প্রজাতন্ত্র, (iii) স্বৈরতন্ত্র। তিি তিনি জনসাধারণের নিরাপত্তা রক্ষা এবং জনগণের মঙ্গলসাধনকে রাষ্ট্রের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য বলে মনে করেন।

[৫] নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র: মন্তেঙ্কু দীর্ঘকাল ইংল্যান্ডে বসবাসের সূত্রে ইংল্যান্ডের নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হন। তাই মন্তেস্কু স্বৈরাচারী বুরবোঁ রাজতন্ত্রের তীব্র সমালোচনা করলেও তিনি নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রকেই সমর্থন করেছেন। অর্থাৎ তিনি পুরোপুরি রাজতন্ত্র উচ্ছেদের পক্ষপাতী ছিলেন না।

[৬] আইনের ধারণা: মন্তেস্কু মূলত প্রাকৃতিক আইনতত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর মতে, আইন জনগণের নিরাপত্তা এবং সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ভীষণ জরুরি।

2. ইক্তা ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো এবং এই ব্যবস্থার ত্রুটিগুলি উল্লেখ করো।

Ans: ভূমিকা: মধ্যযুগে ভারতে সুলতানি আমলে ‘ইত্তা ব্যবস্থার’ উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। ঐতিহাসিক কে এ নিজামি বলেছেন, ইসলামের আবির্ভাবের সূচনাকাল থেকেই ইসলামীয় জগতে ইক্তা ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। কে এম আশরাফের মতে, খলিফা মুকতদির ছিলেন ছলেন সম্ভবত এই প্রথার উদ্ভাবক। দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিস ভারতে এই প্রথার প্রবর্তন করেন এবং তাকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান করেন।

ইক্তার অর্থ: ‘ইত্তা’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল ‘এক অংশ’ বা এলাকা। কিন্তু আসলে এটি ছিল এক ধরনের ভূমিদান ও ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্ত ব্যবস্থা। ইসলামীয় বিধান অনুসারে কৃষকদের উৎপাদনের উদ্বৃত্তের একাংশ রাষ্ট্রের প্রাপ্য বলে বিবেচিত হত। কৃষকদের এই উৎপাদনের উদ্বৃত্তের অংশ সংগ্রহ করা এবং তা শাসকশ্রেণির মধ্যে বিলিবণ্টন করার পদ্ধতিকে সাধারণভাবে ইত্তা প্রথা বলা হয়। সুলতানি আমলে নতুন নতুন জয় করা অঞ্চলগুলি থেকে ভূমিরাজস্ব আদায় এবং এইসকল অঞ্চলগুলিতে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সুলতানরা শাসকশ্রেণির মধ্যে জমি বা এলাকা বণ্টন করে দিতেন। এই জমি বা এলাকাকে বলা হত ইত্তা।

ইক্তা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য: একাদশ শতকের তুর্কি লেখক নিজাম-উল-তুসির লেখা ‘সিয়াসৎ নামা’ গ্রন্থ থেকে ইক্তা ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে একটা ধারণা লাভ করা যায়। এই ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল-

[১] ইক্তাদার বা মাক্তি: ইক্তার প্রাপক বা মালিককে বলা হত ‘ইক্তাদার’ বা ‘মাক্তি’ বা ‘মুক্তি’। এঁরা ‘ওয়ালি’ বা ‘উলিয়াৎ’ নামেও পরিচিত ছিলেন। এঁরা ছিলেন ইক্তার প্রশাসনিক প্রধান।

[২] প্রাদেশিক শাসনের ভিত্তি: ইলতুৎমিসের সময় থেকেই দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের আয়তন দিন দিন বৃদ্ধি পায়। এই নববিজিত অঞ্চল বা বিশেষত দূরবর্তী প্রদেশগুলি থেকে রাজস্ব আদায়, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা ও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়। তাই সুলতানরা নির্দিষ্ট শর্তে ও কাজের বিনিময়ে তাঁর অনুগত সেনাপতি, সৈনিক বা অভিজাতদের মধ্যে এইসকল এলাকা বা অঞ্চল বিলিবণ্টন করে দেন। এইভাবে ইক্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে সুলতানি আমলে প্রাদেশিক শাসনের ভিত্তি গড়ে ওঠে।

[৩] রাজস্ব সংগ্রহ: ইক্তাদাররা তাঁর ইক্তার অধীন কৃষকদের কাছ থেকে নিয়মিত রাজস্ব বা কর সংগ্রহ করতেন। রাজস্ব আদায় ছাড়া কৃষক প্রজাদের জীবন, পরিবার ও সম্পত্তির ওপর তাঁর আর কোনো অধিকার ছিল না।

[৪] দায়িত্ব ও কর্তব্য: ইক্তার রাজস্ব আদায় ও ভোগদখলের বিনিময়ে ইক্তাদারদের নানা সামরিক ও প্রশাসনিক দায়দায়িত্ব পালন করতে হত। যথা (i) ইক্তার উদ্বৃত্ত রাজস্ব সুলতানের কোশাগারে জমা দিতে হত। (ii) ইক্তার আয় থেকে ইক্তাদারকে সৈন্যবাহিনী পোষণ করতে হত। যুদ্ধের সময় সুলতানকে সৈন্যবাহিনী দিয়ে সাহায্য করতে হত। ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব বলেছেন “মাক্তি ছিল একাধারে রাজস্ব সংগ্রহকারী, সেনাপতি ও সেনাবাহিনীর বেতন প্রদানকারী।” (iii) ইক্তাদার বা মাক্তিকে ইক্তার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বও পালন করতে হত।

[৫] নিয়োগ ও বদলি: ইক্তাদার বা মাক্তিকে নিয়োগ করতেন সুলতান। সাম্রাজ্যের স্বার্থে সুলতান তাঁদের অনেক সময় এক ইক্তা থেকে অন্য ইক্তায় বদলি করতেন।

[৬] সুলতানের প্রতি আনুগত্য: যেহেতু ইক্তাদারদের নিয়োগ, বদলি ও পদচ্যুতি সবই ছিল সুলতানের মর্জির ওপর নির্ভরশীল, তাই তাঁরা সুলতানের প্রতি সর্বদা আনুগত্য দেখাতে বাধ্য হতেন।

[৭] শাস্তি: ইক্তার আইনকানুন ভঙ্গ করলে বা দুর্নীতি প্রমাণিত হলে সুলতান ইক্তাদারকে কঠোর শাস্তি দিতেন। এমনকি তাঁর ইক্তাকে বাজেয়াপ্তও করতেন।

ইক্তা ব্যবস্থার ত্রুটি: সুলতানি আমলে প্রচলিত ইক্তা ব্যবস্থার মধ্যে নানা ত্রুটি লক্ষ করা যায়। এগুলি হল –

[১] দুর্নীতি: ইক্তাদারদের অধিকাংশই ছিলেন দুর্নীতিপরায়ণ। ইক্তার উদ্বৃত্ত রাজস্বের যথাযথ হিসাব না-দেখিয়ে রাজকোশে না-পাঠিয়ে তাঁরা নিজেরাই তা আত্মসাৎ করতেন।

[২] শোষণ: অতিরিক্ত অর্থের লোভে মাক্তিরা অনেক সময় তাঁর নির্দিষ্ট ইক্তায় ইজারাদারদের মাধ্যমে কৃষক বা প্রজাদের ওপর আর্থিক শোষণ চালাতেন।

[৩] রাজস্ব হ্রাস: ইক্তা ব্যবস্থার ব্যাপক প্রচলনের ফলে সুলতানের খালিসা জমির পরিমাণ কমতে থাকে। ফলে সরকারি রাজস্বের পরিমাণ উত্তরোত্তর হ্রাস পায়।

[৪] সামন্ততান্ত্রিক উপাদান: ইক্তা ব্যবস্থা প্রথমদিকে বংশানুক্রমিক ছিল না। কিন্তু ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমল থেকে এই প্রথা বংশানুক্রমিক হয়ে যাওয়ার ফলে এই ব্যবস্থার মধ্যে সামন্ততন্ত্রের লক্ষণগুলি ফুটে ওঠে।

মূল্যায়ন: উক্ত আলোচনার ভিত্তিতে সবশেষে বলা যায় যে, দিল্লির সুলতানরা মূলত নববিজিত অঞ্চল থেকে রাজস্ব আদায় এবং কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে ইক্তা ব্যবস্থাকে একটা ‘হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমল থেকে এই প্রথা বংশানুক্রমিক হয়ে যাওয়ায় দূরবর্তী প্রদেশগুলিতে সুলতানের কর্তৃত্ব শিথিল হয়ে পড়ে। ফলে সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।

3. ইত্তা প্রথা’ কী এবং এই প্রথার উদ্ভব ও গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো।

Ans: ভূমিকা: দিল্লির সুলতানি শাসনকালে ভূমিরাজস্ব প্রশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ইত্তা প্রথা। ভারতে প্রচলনের বহুকাল আগে থেকেই এই প্রথা ইসলামীয় জগতে প্রচলিত ছিল। সুলতান ইলতুৎমিস ভারতে প্রথম এই প্রথার প্রচলন করেন। এই প্রথা প্রবর্তনের পিছনে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল নববিজিত অঞ্চল থেকে রাজস্ব আদায় করা এবং দূরবর্তী অঞ্চলগুলিতে সুলতানের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। একাদশ শতকের তুর্কি লেখক নিজাম-উল-মুলক তুসির লেখা সিয়াসৎনামা গ্রন্থ থেকে ইক্তা প্রথা সম্পর্কে একটা ধারণা লাভ করা সম্ভব হয়েছে।

ইক্তা ব্যবস্থা:

অর্থ: ইত্তা শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল এক অংশ বা এলাকা। কিন্তু বাস্তবে এটি ছিল ইসলাম জগতে প্রচলিত এক ধরনের ভূমিদান ও ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্ত ব্যবস্থা। একজন শাসক তাঁর বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের প্রতি সেবার পুরস্কার হিসেবে এ ধরনের ভূমি বা এলাকা বণ্টন করতেন। সাধারণভাবে এটি ইক্তা প্রথা নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক মোরল্যান্ড বলেছেন যে, “ভারতে সুলতানি আমলে ছোটো বা বড়ো ভূখণ্ড থেকে ভূমিরাজস্ব আদায়ের অধিকারই হল ইত্তা ব্যবস্থা।”

ইক্তাদার বা মাক্তি: ইক্তার প্রাপক বা মালিককে বলা হত ইক্তাদার বা মাক্তি বা মুক্তি। এঁরা ওয়ালি বা উলিয়াৎ নামেও পরিচিত ছিলেন।

ইক্তাদারদের দায়িত্ব ও কর্তব্য: (i) প্রত্যেক ইক্তাদার তাঁর নির্দিষ্ট এলাকার প্রজাদের কাছ থেকে ভূমিরাজস্ব আদায় করতেন। কিন্তু ভূমিরাজস্ব আদায় ছাড়া জমি ও কৃষকদের। কদের ওপর তাঁর কোনো অধিকার ছিল না। (ii) ইক্তার আয় থেকে তাঁকে সেনাবাহিনী পোষণ করতে হত এবং যুদ্ধের সময় তাঁরা সুলতানকে সামরিক সাহায্য দিতে বাধ্য থাকতেন। তাই ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব বলেছেন, “মাক্তিরা ছিলেন একাধারে রাজস্ব আদায়কারী, সেনাবাহিনীর অধ্যক্ষ ও তাঁদের বেতনদাতা।” (iii) ইক্তাদারদের নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদচ্যুতি-সবই ছিল সুলতানের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। (iv) ইক্তাদার বা মাক্তিদের স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি কিছু প্রশাসনিক দায়দায়িত্বও পালন করতে হত।

ইক্তা প্রথার উদ্ভব: ইসলামের আবির্ভাবের সূচনাকাল থেকেই রাষ্ট্রীয় সেবার পুরস্কার হিসেবে ইসলামীয় জগতে ইক্তা ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। ঐতিহাসিক কে এম আশরাফ বলেছেন যে সম্ভবত খলিফা মুকতদি এই প্রথার উদ্ভাবক ছিলেন। ইসলামের রাষ্ট্রব্যবস্থায় কৃষকদের উৎপাদনের উদ্বৃত্তের একটি অংশ রাষ্ট্রের প্রাপ্য বলে বিবেচিত হত। তাই এদেশে সুলতানি সাম্রাজ্যের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে কৃষকদের এই উদ্বৃত্ত উৎপাদনের অংশ সংগ্রহ করা এবং তা শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে বণ্টন করার উদ্দেশ্যেই ইক্তা প্রথার প্রচলন ঘটে। সুলতানরা নির্দিষ্ট শর্তে তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি, সৈনিক ও অভিজাতদের মধ্যেই জমি বণ্টন করে দিতেন। এই জমি বা এলাকা ইত্তা নামে পরিচিত হয়।

ইক্তা প্রথার গুরুত্ব: ইক্তা ব্যবস্থার মধ্যে নানা ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলেও এই ব্যবস্থার সুফল বা গুরুত্বকে পুরোপুরি অস্বীকার করা যায় না। এগুলি হল-

[১] সাম্রাজ্যের প্রসার: ইক্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে দিল্লির সুলতানরা ভারতে নিত্যনতুন অঞ্চলে তাঁদের কর্তৃত্ব ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ফলে সুলতানি সাম্রাজ্যের বিস্তার বা প্রসার ঘটে।

[২] দূরবর্তী অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন: ইক্তা প্রথার মাধ্যমে সুলতানরা রাজধানী দিল্লি থেকে দূরবর্তী প্রদেশ বা অঞ্চলগুলির ওপর কর্তৃত্ব ও যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা সুরক্ষিত হয়েছিল।

[৩] রাজকোশের আয় বৃদ্ধি: ইক্তাদাররা বিপুল পরিমাণে ভূমিরাজস্ব সংগ্রহ করে সুলতানদের রাজকীয় কোশাগারে জমা দিতেন। এইভাবে সুলতানের রাজকোশের আয় বৃদ্ধি পায়।

[৪] প্রশাসনের ত্রুটিবিচ্যুতি দূরীকরণ: ইক্তা প্রথা প্রবর্তনের মাধ্যমে যেমন সুলতানি আমলে প্রাদেশিক শাসনের ভিত মজবুত হয়েছিল। এর পাশাপাশি প্রশাসনের নানা ত্রুটিবিচ্যুতিও দূর হয়েছিল।

[৫] অভিজাত শ্রেণির সন্তুষ্টি বিধান: দিল্লিতে প্রথমদিকে মামেলুক বা দাস সুলতানরা আমির-ওমরাহ বা অভিজাতদের বিদ্রোহের আশঙ্কা করতেন। তাই তাঁদের খুশি করার জন্য তাঁরা ইক্তা প্রদান করতেন।

মূল্যায়ন: সবশেষে বলা যায় যে, সুলতান ইলতুৎমিস নতুন নতুন অঞ্চলের ওপর কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে মূলত এদেশে ইক্তা প্রথার প্রবর্তন করেন। নতুনভাবে জয় করা অঞ্চলের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণে রাখা, ভূমিরাজস্ব থেকে রাজকোশের আয় বৃদ্ধি করাও ছিল তাঁর অন্যতম লক্ষ্য। আবার ঐতিহাসিক কে এ নিজামি সহ অনেকেই বলেছেন যে, ভারতের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করার জন্য ইলতুৎমিস ইক্তা ব্যবস্থাকে একটি ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।

4. ‘ইত্তা’ ব্যবস্থার বিবর্তন আলোচনা করো। অথবা, সুলতানি যুগে ইক্তা ব্যবস্থার বিবর্তন সম্পর্কে লেখো।

Ans: ভূমিকা: মধ্যযুগে ভারতে সুলতানি শাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল ইক্তা ব্যবস্থা। ইসলামের আবির্ভাবের প্রায় সূচনাকাল থেকেই ইসলামীয় জগতে এই ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। ঐতিহাসিক কে এম আশরাফ বলেছেন, সম্ভবত খলিফা মুকতিদির এই প্রথার উদ্ভাবক ছিলেন। তবে ভারতে এই প্রথার প্রবর্তক ছিলেন সুলতান ইলতুৎমিস। তাঁর পরবর্তী সুলতানদের আমলে ইক্তা ব্যবস্থার মধ্যে নানা পরিবর্তন ও সংযোজন ঘটেছিল।

[১] ইলতুৎমিসের আমলে ইক্তা ব্যবস্থা: সুলতান ইলতুৎমিসই ভারতে প্রথম ইক্তা ব্যবস্থাকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল নববিজিত অঞ্চলের ওপর সুলতানের দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। এজন্য তিনি তাঁর বিশ্বস্ত সমরনায়কদের মধ্যে এই নতুন নতুন জয় করা অঞ্চলগুলিকে ইক্তা হিসেবে বিলি করেন। তবে তিনি মাক্তিদের বিভিন্ন ইক্তায় বদলির ব্যবস্থা করেন যাতে ভবিষ্যতে মাক্তিরা নিজ এলাকায় স্বাধীন ও ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে না পারেন। এইভাবে তিনি ইক্তা ব্যবস্থাকে প্রাদেশিক শাসনের ভিত্তি হিসেবে গড়ে তোলেন।

[২] গিয়াসউদ্দিনের আমলে ইক্তা ব্যবস্থা: ইলতুৎমিসের উত্তরাধিকারীদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছিলেন মাক্তিরা। কিন্তু বলবন সিংহাসনে বসার পর তিনি তাঁদের কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি ইত্তা ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য কিছু পরিবর্তন ঘটান। যেমন-

(i) ইতিমধ্যে মাক্তিদের অনেকেই মৃত কিংবা বার্ধক্যের কারণে অকর্মণ্য হয়ে পড়েছিলেন। তিনি এই ইক্তাগুলিকে বাজেয়াপ্ত করেন।

(ii) ইক্তাদারদের অধিকাংশই কর ফাঁকি দিতেন। তাঁদের এই দুর্নীতি রোধ করার উদ্দেশ্যে। তিনি প্রায় প্রতিটি ইক্তায় খোয়াজা নামক এক শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ করেন। এঁরা ইক্তার প্রকৃত আয়, ব্যয় ও উদ্বৃত্ত অর্থের হিসাব রাখতেন। এইভাবে তিনি ইক্তা ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করেন।

[৩] আলাউদ্দিন খলজির আমলে ইক্তা ব্যবস্থা: আলাউদ্দিন খলজির আমলে সুলতানি সাম্রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি পাওয়ায় এই ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে যথা-

(i) তিনি দিল্লির দূরবর্তী নববিজিত অঞ্চলগুলিকে ইক্তায় পরিণত করে তা সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন।

(ii) দিল্লির নিকটবর্তী অঞ্চলগুলিকে তিনি খালিসা জমিতে পরিণত ১০০ করে সরকারি রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি করেন।

(iii) তিনি রাজস্ব দপ্তর মারফত প্রতিটি ইক্তার রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেন।

(iv) তিনি সৈন্যদের ইক্তার পরিবর্তে নগদ বেতন দেওয়ার রীতি চালু করেন।

(v) দুর্নীতিগ্রস্ত ইক্তাদারদের তিনি কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করেন।

[৪] মহম্মদ-বিন-তুঘলকের আমলে ইক্তা ব্যবস্থা: গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের আমলে ইক্তা ব্যবস্থায় তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেনি। তিনি কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় নীতির কঠোরতা কিছুটা শিথিল করেন। কিন্তু মহম্মদ বিন তুঘলকের আমলে ইক্তা ব্যবস্থায় বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটানো হয়, যথা –

(i) ঐতিহাসিক বরণী, ইসামি, ইবন বতুতা প্রমুখের রচনা থেকে জানা যায় যে মহম্মদ বিন তুঘলক রাজস্ব সংগ্রহ ও সৈন্য রক্ষণাবেক্ষণ কাজ দুটিকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দেন।

(ii) তিনি নিলামের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ রাজস্ব প্রদানের ইচ্ছুক ব্যক্তিদেরই ইক্তার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেন।

[৫] ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলে ইক্তা ব্যবস্থা: সুলতান হিসেবে ফিরোজ শাহ তুঘলক ছিলেন যথেষ্ট উদার ও দুর্বল চিত্ত। তাই তিনি সিংহাসনে বসে অভিজাত শ্রেণিকে নানা ধরনের সুযোগসুবিধা দিয়েছিলেন। ফলে ইক্তা ব্যবস্থায় নানা পরিবর্তন ঘটে। যেমন-

(i) তাঁর আমলে ইক্তা ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ে।

(ii) তিনি অভিজাতদের ব্যাপক হারে ইক্তা বিলি করায় ‘খালিসা’ জমির পরিমাণ হ্রাস পায়। ফলে রাজকীয় আয় কমে যায়। এটি সুলতানি সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়।

(iii) ইক্তা ব্যবস্থাকে তিনি বংশানুক্রমিক করে দেন।

(iv) তাঁর আমলে ইক্তার হিসাবপরীক্ষার বিষয়টি ক্রমশ শিথিল হয়ে পড়ে।

(v) ফিরোজ শাহ তুঘলক সেনাদের নগদ বেতন দেওয়ার পরিবর্তে গ্রামের খাজনা আদায় করার অধিকার দেন। একে বলা হত ওয়াঝ। ঐতিহাসিক আফিফ বলেছেন, ফিরোজ শাহ সমস্ত রাজস্ব, ইক্তা এবং পরগনাগুলি জনগণের মধ্যে বণ্টন করে দেন।

[৬] সৈয়দ ও লোদি আমলে ইক্তা ব্যবস্থা: সুলতান ফিরোজ শাহের মৃত্যুর পর ইক্তার ওপর আর আগের মতো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। সৈয়দ ও লোদি সুলতানদের আমলেও ইক্তা ব্যবস্থার মৌলিক চরিত্রের তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এ সময় থেকে ইক্তার পরিবর্তে ‘সরকার’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।

মূল্যায়ন: উক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায় যে, সুলতানি যুগে ইক্তা ব্যবস্থার মূল কাঠামোটি অক্ষুণ্ণ থাকলেও বিভিন্ন সুলতানদের আমলে এই ব্যবস্থার মধ্যে নানা পরিবর্তন ঘটেছিল। শক্তিশালী সুলতানেরা ইক্তাদারদের যেভাবে কাঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছিলেন, দুর্বল সুলতানদের আমলে তা সম্ভব হয়নি। বিশেষত সুলতান ফিরোজের দুর্বল শাসননীতির ফলে ইক্তা ব্যবস্থার মধ্যে সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতা ক্রমশই বাড়তে থাকে। এই ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে জায়গির ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।

5. মনসবদারি ব্যবস্থা’ কী এবং আকবর পরবর্তী সম্রাটদের আমলে মনসবদারি প্রথার বিবরণ দাও।

Ans: ভূমিকা: মনসবদারি প্রথার উৎপত্তি মধ্য এশিয়ায়। এটি ছিল মূলত একটি পারসিক প্রথা। চেঙ্গিস খান ও তৈমুর লঙের শাসনব্যবস্থায় এই প্রথা ভিন্ন ধারায় প্রচলিত ছিল। এমনকি ভারতে আলাউদ্দিন খলজি ও শেরশাহের আমলেও এই প্রথা কিছুটা স্বতন্ত্র বা পৃথক ধারায় প্রচলিত ছিল বলে একদল ঐতিহাসিক মনে করেন। তবে ভারতে সমগ্র মোগল যুগে যে মনসবদারি ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল তার প্রবর্তক ছিলেন সম্রাট আকবর। তিনি ভারতে মনসবদারি ব্যবস্থাকে একটি সুসংবদ্ধ রূপ দেন। আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরি ও সমকালীন লেখকদের রচনা থেকে মনসবদারি প্রথা সম্পর্কে নানা তথ্য জানা যায়।

মনসবদারি ব্যবস্থা:

অর্থ: ‘মনসবদার’ কথাটির উৎপত্তি ‘মনসব’ শব্দ থেকে। মনসব শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল পদ বা পদমর্যাদা (Rank)। এই পদমর্যাদার অধিকারী ব্যক্তিরা মনসবদার নামে পরিচিত। এই অর্থে মোগল প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত উচ্চ পদাধিকারী ব্যক্তিরা ‘মনসবদার’ নামে পরিচিত ছিলেন।

বৈশিষ্ট্য: আকবরের সময় থেকে সামরিক ও অসামরিক উভয় কাজের ক্ষেত্রেই মনসব প্রদান করা হত। প্রত্যেক মনসবদারকেই তাঁর পদমর্যাদা অনুযায়ী নির্দিষ্টসংখ্যক পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্য রাখতে হত। কারণ মনসবদারদের যুদ্ধের সময় সম্রাটকে সৈন্যবাহিনী দিয়ে সাহায্য করতে হত। অধিকাংশ ঐতিহাসিকরা মনে করেন আকবরের আমলে মনসবদারদের ৩৩টি স্তরের অস্তিত্ব ছিল।

মনসবদারদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও পদচ্যুতি সবই ছিল সম্রাটের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। মনসবদারদের দুই ভাবে বেতন দেওয়া হত-(1) নগদে এবং (ii) জমি বা জায়গির প্রদানের মাধ্যমে। আকবর এই প্রথায় জাট ও সওয়ার নামক দুটি পদের সংযোজন করেন। এই প্রথা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল মোগল প্রশাসনকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা।

আকবর পরবর্তী সম্রাটদের মনসবদারি প্রথা:

[১] জাহাঙ্গিরের আমলে মনসবদারি প্রথা: আকবরের পর মোগল সিংহাসনে বসেন সম্রাট জাহাঙ্গির। তিনি তাঁর পিতা আকবর প্রবর্তিত মনসবদারি ব্যবস্থাকেই বহাল রাখেন। তবে তিনি এই প্রথায় সামান্য কিছু পরিবর্তন ও সংযোজন করেন। এগুলি হল- (i) জাহাঙ্গির মনসবদারি প্রথায় দু-আস্পা ও শি-আস্পা পদের সংযোজন ঘটান। অর্থাৎ যাঁর অধীনে দুটি ঘোড়া থাকত, তাঁকে বলা হত দু-আম্পা। আর যাঁর অধীনে তিনটি ঘোড়া থাকত, তাঁকে বলা হত শি-আম্পা। দাক্ষিণাত্যের সুবাদার মহাবৎ খাঁ প্রথম এই পদের অধিকার পান। (ii) আকবরের সময়ে মনসবদাররা প্রত্যেক অশ্বারোহী সেনার জন্য বছরে ২৪০ টাকা (দাম) পেতেন। জাহাঙ্গির তা কমিয়ে ২০০ টাকা (দাম) করেন।

[২] শাহজাহানের আমলে মনসবদারি প্রথা: সম্রাট শাহজাহানের আমলে দু-আসপা ও শি-আস্সা পদের সংখ্যা অনেক বেড়েছিল। তিনি এই ব্যবস্থায় কিন্তু পরিবর্তন ঘটান। মনসবদারদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকায় তাঁদের বেতন সংকোচন করতে তিনি বাধ্য হন। এজন্য তিনি বার্ষিক বেতনের পরিবর্তে মাস অনুপাতে (১০ মাস, ৮ মাস, ৬ মাস) বেতন দেওয়ার রীতি চালু করেন।

[৩] ঔরঙ্গজেবের আমলে মনসবদারি প্রথা: পূর্ববর্তী মোগল সম্রাটদের আমলে প্রচলিত মনসবদারি ব্যবস্থা তাঁর আমলেও বহাল ছিল। তবে জাহাঙ্গির ও শাহজাহানের আমল থেকে মনসবদারদের সংখ্যা ও দুর্নীতি যে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল, তা তাঁর আমলে চরম আকার ধারণ করে। মনসবদারদের এই দুর্নীতি দূর করতে তিনি দাগ ও চেহরা প্রথাকে আরও কড়াকড়ি করেন।

মূল্যায়ন: সবশেষে বলা যায় যে, মনসবদারি প্রথা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে আকবর একটি বিশাল সৈন্যদল ও দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তাঁর প্রবর্তিত ব্যবস্থাই পরবর্তী মোগল সম্রাটদের আমলে প্রচলিত ছিল। তবে আকবরের রাজত্বের শেষ দিক থেকে এই ব্যবস্থায় – নানা সংযোজন ও পরিবর্তন ঘটেছিল। কিন্তু সম্রাট জাহাঙ্গির, শাহজাহান ও ঔরঙ্গজেবের আমলে ভালো মানের জায়গির লাভের আশায় মনসবদাররা নিজেদের মধ্যে কলহ ও দ্বন্দে লিপ্ত হয়ে পড়েন। ফলে মোগল শাসনের ভিত ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ে। এই কারণে আরভিন, মোেরল্যান্ড প্রমুখ একদল ঐতিহাসিক মোগল সাম্রাজ্যের পতনে মনসবদারি ব্যবস্থাকে দায়ী করেছেন।

6. কৌটিল্য ‘অর্থশাস্ত্র’-এ রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেন তা ব্যাখ্যা করো। অথবা, রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে কৌটিল্য ‘অর্থশাস্ত্র’-এ কী অভিমত ব্যক্ত করেছেন?

Ans: ভূমিকা: প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বহু মূল্যবান গ্রন্থ হল কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ড. শ্যাম শাস্ত্রী সংস্কৃত ভাষায় লেখা এই গ্রন্থটি আবিষ্কার করেন। এই গ্রন্থটির রচয়িতা সম্পর্কে বিতর্ক থাকলেও অধিকাংশ পণ্ডিত মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্য বা চাণক্যকেই অর্থশাস্ত্রের রচয়িতা বলে স্বীকার করেছেন। তবে পন্ডিতদের অনুমান বিভিন্ন যুগে গ্রন্থটি নানাভাবে পরিমার্জিত হয়েছে। অর্থশাস্ত্রের মূল বিষয়বস্তু রাষ্ট্রনীতি হলেও এই গ্রন্থটিতে মৌর্য যুগ তথা প্রাচীন ভারতের সমাজ, অর্থনীতি প্রভৃতি অন্যান্য বিষয়ও আলোচিত হয়েছে।

অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে ধারণা: অর্থশাস্ত্রে উল্লেখিত রাষ্ট্রনীতির বিভিন্ন দিকগুলি হল-

[১] শক্তিশালী ও বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র: অর্থশাস্ত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ না-থাকলেও কৌটিল্য মূলত শক্তিশালী ও বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রকেই সমর্থন করেছেন। তাঁর মতে, রাজা উচ্চবংশজাত হওয়াই ব্যঞ্জনীয়। কেন-না বংশকৌলীন্যের কারণে সহজেই তিনি প্রজাসাধারণের আনুগত্য ও ভক্তিশ্রদ্ধা অর্জন করতে সক্ষম হবেন।

[২] রাষ্ট্রের সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব: কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’-এ বলা হয়েছে যে, মানবদেহের ন্যায় রাষ্ট্রেরও বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আছে। কৌটিল্যের মতে, রাষ্ট্র মূলত সাতটি অঙ্গ দ্বারা গঠিত। এগুলি হল- (i) স্বামী (রাজা), (ii) অমাত্য (আমলা গোষ্ঠী), (iii) জনপদ (রাষ্ট্র), (iv) দুর্গ (পুর-নগর), (v) কোশ (অর্থভাণ্ডার), (vi) দণ্ড (শাস্তিবিধান), এবং (vii) মিত্র (বন্ধু রাজা বা রাষ্ট্র)। এই সাতটি অঙ্গ রাষ্ট্রের ‘সপ্তাঙ্গতত্ত্ব’ নামে পরিচিত।

[৩] রাজার ক্ষমতা: কৌটিল্যের মতে, রাজা হলেন রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা। অর্থাৎ তিনিই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বা চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর কর্তৃত্ব ও আদেশকে উপেক্ষা বা অমান্য করার ক্ষমতা কারও নেই। তিনি রাষ্ট্রের সামরিক ও বেসামরিক শাসন এবং বিচারব্যবস্থার প্রধান। তবে অর্থশাস্ত্রে তাঁর অবাধ ও স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতাকে অবশ্য স্বীকার করা হয়নি। অর্থশাস্ত্রে, তাঁর সীমাহীন ক্ষমতার ওপর কিছু নিয়ন্ত্রণ আরোপের কথাও বলা হয়েছে। কৌটিল্যের মতে, রাজাই রাষ্ট্র নয়, তিনি এর অংশমাত্র।

[৪] রাজার কার্যাবলি: কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে রাজার গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। যথা- (i) কৌটিল্যের মতে, রাজার প্রধান কর্তব্য হল প্রজাদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করা। (ii) বহিঃশত্রুর আক্রমণ, নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়, রোগ-ব্যাধি, দস্যু-দুষ্কৃতীদের হাত থেকে প্রজাদের নিরাপত্তা বিধান করা। (iii) রাজার অন্যতম কাজ হল একটি সৎ ও দক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলা। (iv) শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাজাকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। (v) বৈদেশিক আক্রমণ ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার স্বার্থে দুর্গ ও নগর নির্মাণ করা।

[৫] রাজার গুণাবলি: কৌটিল্যের মতে, রাজাকে হতে হবে কূটনীতিপরায়ণ। সব ধরনের কাজের ক্ষেত্রেই রাজার মধ্যে থাকতে হবে উৎসাহ, উদ্দীপনা ও কর্মপ্রেরণা। রাজাকে হতে হবে সাহসী, ন্যায়পরায়ণ, ধর্মপরায়ণ, দৃঢ়চেতা, বিচক্ষণ ও সংযমী।

[৬] সুদক্ষ আমলাতন্ত্র গঠন: কৌটিল্যের মতে, রাজার একার পক্ষে রাষ্ট্রশাসন পরিচালনা করা সম্ভব নয়। এজন্য তিনি বিভিন্ন মন্ত্রী, অমাত্য ও অন্যান্য রাজকর্মচারীদের নিয়োগ করবেন এবং আমলাতন্ত্রের সাহায্যে রাজা শাসন পরিচালনা করবেন।

[৭] প্রজাকল্যাণকর রাষ্ট্র: কৌটিল্য তাঁর ‘অর্থশাস্ত্র’-এ প্রজাকল্যাণকর রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই সমর্থন করেছেন। তাঁর মতে, রাজাকে হতে হবে প্রজাদরদি। প্রজাসাধারণের মঙ্গলসাধন করাই তাঁর অন্যতম প্রধান কর্তব্য। নিজের সুখের থেকেও প্রজার সুখ রাজার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, “প্রজার সুখেই রাজার সুখ, প্রজার হিতে (মঙ্গল) রাজার হিত” (প্রজাসুখে সুখং রাজ্ঞঃ প্রজানাং চ হিতে হিতম)।

[৮] বিচার ও আইনব্যবস্থা: রাজাই হলেন রাষ্ট্রে বিচার বিভাগের সর্বেসর্বা। রাষ্ট্রের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং অপরাধীকে দণ্ড বা শাস্তিদান করা রাজার অন্যতম কর্তব্য বলে কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ করেছেন। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কঠোর আইন প্রণয়ন ও দণ্ডদানের পক্ষেই তিনি মত দিয়েছেন।

[৯] রাজস্বব্যবস্থা: কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে বলেছেন যে, সুষ্ঠুভাবে শাসন পরিচালনার জন্য রাজকোশ সমৃদ্ধ হওয়া দরকার। কেন-না, দুর্বল বা শূন্য রাজকোশ রাজা ও প্রজার উভয়েরই দুর্গতির অন্যতম মূল কারণ। তাই রাজস্ব নির্ধারণ, রাজস্ব সংগ্রহ ও বৃদ্ধির ব্যাপারে রাজাকে সর্বদাই নজর রাখতে হবে। রাষ্ট্রের রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য রাজাকে কৃষি, শিল্প ও ব্যাবসাবাণিজ্যের উন্নতির ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে। অর্থশাস্ত্রে তিনি সীতা, ভাগ ও বলি নামে তিনপ্রকার করের কথা উল্লেখ করেছেন।

[১০] গুপ্তচর ব্যবস্থা: মৌর্য শাসনব্যবস্থা আলোচনা প্রসঙ্গে কৌটিল্য গুপ্তচর ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন। কৌটিল্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ও বাইরে নানা খবরাখবর সংগ্রহের জন্য রাজাকে গুপ্তচর নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন।

[১১] ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা: কৌটিল্য রাষ্ট্রের আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় বিষয়ে পুরোহিতের কর্তৃত্বকে কৌটিল্য মেনে নিলেও রাজার ক্ষমতাকে প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা পুরোহিতের নেই। এমনকি পুরোহিত অপরাধ করলে তিনি তাঁদের চরম শাস্তির বিধান দিয়েছেন। বিচারক ও রাজকর্মচারীদের নিয়োগের আগে তাদের ধর্মনিরপেক্ষতাকে যাচাই-এর পরামর্শ দিয়েছেন।

মূল্যায়ন: সবশেষে বলা যায় যে, মৌর্য যুগ তথা প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রনীতি চর্চার সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হল কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র। এই গ্রন্থে প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত নানা বিধিব্যবস্থা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। ঐতিহাসিক আলতেকর বলেছেন যে, কৌটিল্য রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে একটি নতুন ধারার প্রবর্তন করেছিলেন। আবার অনেকে মনে করেন, আধুনিক রাষ্ট্রনীতি চর্চায় ম্যাকিয়াভেলির যে স্থান, প্রাচীন যুগের রাষ্ট্রনীতি চর্চায় কৌটিল্যের স্থানও অনুরূপ। তাই কৌটিল্যকে অনেকেই ‘ভারতের ম্যাকিয়াভেলি’ বলে অভিহিত করেন।

7. ‘অর্থশাস্ত্র’-এ উল্লিখিত সপ্তাঙ্গতত্ত্ব সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

Ans: ভূমিকা: প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হল কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র। এই গ্রন্থে তিনি রাষ্ট্রব্যবস্থার বিভিন্ন দিকগুলি তুলে ধরেছেন। কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রকে জীবদেহের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, মানবদেহের ন্যায় রাষ্ট্রেরও বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আছে। তাঁর মতে, রাষ্ট্র মূলত সাতটি অঙ্গ দ্বারা গঠিত। এগুলি হল-স্বামী, অমাত্য, জনপদ, দুর্গ, কোশ, দণ্ড এবং মিত্র। এটি কৌটিল্যের সপ্তাঙ্গতত্ত্ব নামে পরিচিত।

[১] স্বামী: সাধারণভাবে স্বামী শব্দটি প্রভু বা প্রধান অর্থে বিভিন্ন প্রাচীন শাস্ত্রে উল্লেখিত হয়েছে। তবে কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে ‘স্বামী বলতে রাজা অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রধানকেই বুঝিয়েছেন। কৌটিল্যের মতে রাষ্ট্রের সাতটি উপাদানের মধ্যে স্বামী বা রাজাই হলেন সর্বাপেক্ষ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কারণ তিনি রাষ্ট্রের প্রধান বা সর্বেসর্বা। কৌটিল্য স্বামী বা রাজার কতকগুলি গুলি অপরিহার্য গুণাবলির কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলি হল ন্যায়পরায়ণতা, ধর্মপরায়ণতা, বিচক্ষণতা, প্রখর স্মৃতিশক্তি, দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ইত্যাদি।

[২] অমাত্য: কৌটিল্য রাষ্ট্রের অন্যতম অঙ্গ হিসেবে অমাত্যদের কথা বলেছেন। অর্থশাস্ত্রে অমাত্য বলতে উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী বা আমলাদের বোঝানো হয়েছে। এইসকল রাজকর্মচারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-পুরোহিত, প্রদেষ্টা, রাজদূত, বিচারক, কোশাধ্যক্ষ, সমাহর্তা প্রমুখ। রাজাই এঁদের নিয়োগ করেন এবং এঁদের প্রধান কাজ হল রাজাকে শাসনকার্যে সহায়তা করা।

[৩] জনপদ: জনপদ বলতে সাধারণত জনবসতিপূর্ণ ভূখণ্ড বা, এলাকাকে বোঝায়। প্রাচীন ভারতীয় বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্রে জনপদ অর্থে রাষ্ট্র কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। কৌটিল্য আবার জনপদ শব্দটির দ্বারা নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ও জনসমষ্টি উভয়কেই বুঝিয়েছেন। তাঁর মতে, ভূখণ্ড এবং জনগণ ছাড়া রাষ্ট্র অস্তিত্বহীন। কৌটিল্য বলেছেন, জনপদ বা রাষ্ট্রে থাকবে উর্বর কৃষিজমি, পশুচারণক্ষেত্র প্রভূত বনজ ও খনিজ সম্পদ।

[৪] দুর্গ: অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল দুর্গ। মনুসংহিতায় দুর্গ শব্দটির সমার্থক শব্দ হল পুর বা নগর। অর্থাৎ প্রাচীরবেষ্টিত নগর। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে চার ধরনের দুর্গের কথা উল্লেখিত হয়েছে। এগুলি হল- (i) পার্বত্য বা গিরিদুর্গ, (ii) জলদুর্গ, (iii) মরুদুর্গ এবং (iv) অরণ্যদুর্গ।

(i) গিরি (পার্বত্য) দুর্গ: চতুর্দিকে পাহাড় বা পর্বত দিয়ে ঘেরা দুর্গের নাম গিরি (পার্বত্য) দুর্গ।

(ii) জলদুর্গ: চতুর্দিকে জল দ্বারা বেষ্টিত দুর্গের নাম জল দুর্গ।

(iii) মরূদুর্গ: মরু অঞ্চলে গঠিত দুর্গ হল মরু দুর্গ।

(iv) অরণ্যদুর্গ: অরণ্য বা বনাঞ্চলকে সুরক্ষিত করার জন্য গঠিত দুর্গের নাম অরণ্য দুর্গ। কৌটিল্য বলেছেন, দুর্গ দ্বারা রাজধানী ও রাজ্যকে সুরক্ষিত করতে হবে।

[৫] কোশ: কোশ বলতে কৌটিল্য রাজকোশ অর্থাৎ রাজার অর্থভান্ডারকে বুঝিয়েছেন। তাঁর মতে, সুষ্ঠুভাবে শাসনকার্য পরিচালনা বিশেষত রাজকর্মচারী ও সৈন্যবাহিনী রক্ষণাবেক্ষণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা ইত্যাদির জন্য রাজকোশ সমৃদ্ধশালী হওয়া দরকার। এজন্য রাজাকে ভূমিরাজস্বের পাশাপাশি সেচ কর, বিভিন্ন ধরনের পণ্য কর সংগ্রহ করে রাজকোশকে সর্বদা পরিপূর্ণ রাখতে হবে।

[৬] দণ্ড: দণ্ড শব্দের সমার্থক শব্দ হল বল। কৌটিল্য অবশ্য দণ্ড বলতে মূলত সেনাবাহিনীকে বুঝিয়েছেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের শক্তি ও স্থায়িত্ব অনেকটাই সামরিক বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল। এই দন্ড বা সেনাবাহিনী মূলত-পদাতিক, অশ্বারোহী, রথ ও হস্তিবাহিনী নিয়ে গঠিত। তাঁর মতে, দণ্ড দ্বারা রাজা দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করবেন।

[৭] মিত্র: কৌটিল্য মিত্র বলতে মূলত বন্ধু রাজা বা বন্ধুভাবাপন্ন রাজ্যকেই বুঝিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মিত্র সাধারণত দুই ধরনের হয়-সহজ বা স্বাভাবিক মিত্র এবং অর্জিত বা কৃত্রিম মিত্র। কৌটিল্য তাকেই স্বাভাবিক মিত্র বলেছেন, যে রাজা বা রাজ্য বংশপরম্পরায় বন্ধুভাবাপন্ন। আবার বিজিত রাজ্যের সঙ্গে মিত্রতার বন্ধনের কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন।।

মূল্যায়ন: সবশেষে বলা যায় যে, কৌটিল্যের রাষ্ট্রনীতি তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল সপ্তাঙ্গতত্ত্ব। ড. রণবীর চক্রবর্তী বলেছেন- “কৌটিল্যের সপ্তাঙ্গতত্ত্বে উল্লেখিত সাতটি অঙ্গের মধ্যে স্বামী বা রাজার স্থান সর্বাগ্রে। কারণ রাষ্ট্রে স্বামী বা রাজা বিপন্ন হলে সেই বিপদ সবচেয়ে মারাত্মক”। তাই রাজা হলেন রাষ্ট্রের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, আর মিত্র বা বন্ধুর গুরুত্ব হল সবচেয়ে গৌণ।

8. দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে জিয়াউদ্দিন বরণীর অভিমত ব্যক্ত করো এবং সুলতানি রাষ্ট্র কি ‘ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র’। রাষ্ট্র’ ছিল? অথবা, দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলোচনা করো।

Ans: ভূমিকা: সুলতানি যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক ও হলেন জিয়াউদ্দিন বরণী। তাঁর রচিত সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত গ্রন্থটি হল ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহী’। তিনি এই তারিখ-ই-ফিরোজশাহী-র সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে রচনা করেন ‘ফতওয়া-ই-জাহান্দারি’। এই গ্রন্থে তিনি রাষ্ট্রনীতি ও দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রাদর্শের মূলকথা: ইংরেজি ‘থিওক্র্যাটিক’ (Theocratic) শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হল ‘ধর্মাশ্রয়ী’ বা পুরোহিততান্ত্রিক রাষ্ট্র। এই থিওক্র্যাটিক শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক শব্দ ‘থিওস’ (Theos) থেকে। এর অর্থ হল ঈশ্বর বা দেবতা (God)। এই অর্থে ঈশ্বর বা তাঁর প্রতিনিধি দ্বারা শাসিত রাষ্ট্রব্যবস্থাই হল ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র। এককথায়, ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র হল ধর্মীয় আদর্শ বা বিধানের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থা।

জিয়াউদ্দিন বরণীর অভিমত: জিয়াউদ্দিন বরণী দীর্ঘকাল উচ্চ রাজপদে অধিষ্ঠিত থাকার ফলে নানা রাজনৈতিক উত্থানপতন ও ঘটনাবলি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এই বাস্তব অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে তিনি রচনা করেন ফতওয়া-ই-জাহান্দারি নামক গ্রন্থটি। এই গ্রন্থে তিনি সুলতানি রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। জিয়াউদ্দিন বরণী দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রকে ‘জাহান্দারি’ বা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে ব্যাখ্যা করেছেন। এই অভিমতের স্বপক্ষে তিনি একাধিক যুক্তি দেখিয়েছেন।

(i) ইসলামীয় আদর্শের বিচ্যুতি: দিল্লির সুলতানরা রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কোরান-শরিয়ত বা ইসলামীয় আদর্শ থেকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিচ্যুত হয়েছিলেন। বরণী লিখেছেন “সুলতান রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নিয়মকানুন (জাওবিৎ) তৈরি করেন”।

(ii) উলেমাদের ক্ষমতা হ্রাস: দিল্লির প্রায় সকল সুলতানই উলেমা বা ধর্মবিশারদদের পরামর্শ অনুযায়ী ধর্মনীতি বা শাসন পরিচালনা করতেন না।

সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি:

[১] ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের পক্ষে যুক্তি: আধুনিক ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ, আর পি ত্রিপাঠী, এ এল শ্রীবাস্তব প্রমুখরা বরণীর মতের বিরোধিতা করে সুলতানি রাষ্ট্রকে ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁদের বক্তব্যের সমর্থনে তাঁরা নানা যুক্তি দেখিয়েছেন। যথা-

(i) শরিয়তের আদর্শ অনুসরণ: ড. ঈশ্বরী প্রসাদ, আর পি ত্রিপাঠী প্রমুখরা মনে করেন দিল্লির সুলতানদের অধিকাংশই শরিয়ত বা ইসলামীয় আদর্শকে অনুসরণ করেই শাসন পরিচালনা করতেন। ড. ঈশ্বরী প্রসাদ বলেছেন, সুলতানি যুগে শরিয়ত অনুসারে অমুসলমানদের কাছ থেকে জিজিয়া কর আদায় করা হত।

(ii) খলিফার প্রতি আনুগত্য: ইসলাম জগতের প্রধান ধর্মগুরু হলেন খলিফা। আলাউদ্দিন খলজি ছাড়া দিল্লির সব সুলতানই খলিফার কাছ থেকে স্বীকৃতি গ্রহণ করেন। সুলতানরা খলিফার প্রতি আনুগত্য দেখানোর পাশাপাশি নিজেদের মুদ্রায় খলিফার নাম খোদাই করতেন এবং তাঁদের নামে খুৎবা পাঠ করতেন।

(iii) উলেমা শ্রেণির প্রাধান্য: উলেমারা ছিলেন মুসলিম ধর্মবিশারদ। আলাউদ্দিন খলজি ও মহম্মদ বিন তুঘলক ছাড়া দিল্লির সকল সুলতানই শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁদের পরামর্শ মেনে চলতেন। উলেমারা চাইতেন সুলতান শরিয়তের বিধান মেনে ভারতবর্ষকে দার-উল-ইসলাম-এ (ইসলামীয় ধর্মরাজ্যে) পরিণত করবেন।

(iv) শাসনকার্যে অমুসলমানদের উপেক্ষা: দিল্লির অধিকাংশ সুলতানই উচ্চ রাজপদগুলিতে মুসলমানদেরই নিয়োগ করতেন। উচ্চ রাজপদে নিয়োগ ও শাসনকার্য পরিচালনায় অমুসলমান বিশেষত হিন্দুরা ভীষণভাবে উপেক্ষিত হত।

[২] ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের বিপক্ষে যুক্তি: ড. সতীশচন্দ্র, ড. মহম্মদ হাবিব, ড. কুরেশি, ড. হাবিবুল্লাহ, প্রমুখ আধুনিক ঐতিহাসিকগণ সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে বরণী অভিমতকেই সমর্থন করেছেন। তাঁরা মনে করেন সুলতানি রাষ্ট্র ধর্মাশ্রয়ী ছিল না, এই রাষ্ট্র ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। তাঁদের বক্তব্যের সমর্থনে যুক্তিগুলি হল-

(i) ইসলামীয় আদর্শের বিচ্যুতি: ইসলামের বিধান অনুসারে মদ্যপান, মৃত্যুদণ্ড, সুদ গ্রহণ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। কিন্তু দিল্লির সুলতানরা এইসকল ইসলামীয় বিধানগুলিকে মান্যতা দেননি। ব্যক্তিগত জীবনেও তাঁরা ইসলামীয় আদর্শকে পুরোপুরি মেনে চলতেন না। র সুলতানর

(ii) খলিফার প্রতি বাহ্যিক আনুগত্য: দিল্লির সুলতানরা ব্যক্তিগত দক্ষতা, যোগ্যতা ও সামরিক শক্তির ওপর ভিত্তি করেই ক্ষমতা দখল করেছিলেন। তাঁদের নিয়োগ, পদচ্যুতি কিছুই খলিফার মর্জির ওপর নির্ভরশীল ছিল না। তাই খলিফার প্রতি আনুগত্য ছিল বাহ্যিক, বাধ্যতামলক নয়।

(iii) উলেমাদের গুরুত্বহীনতা: দিল্লির অধিকাংশ সুলতানদের আমলেই রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে উলেমাদের কোনো গুরুত্ব বা ভূমিকা ছিল না। উলেমাদের নির্দেশ অনুযায়ী সুলতানরা চলতেন না। বরং অনেক সময়ে তাঁরা সুলতানদের ইচ্ছানুযায়ী চলতে বাধ্য হতেন। এমনকি শরিয়তের ব্যাখ্যাকেও পরিবর্তন করে নিতেন।

(iv) স্বতন্ত্র রাজতন্ত্র: কোরানে বর্ণিত ইসলামীয় ধর্মরাজ্যের সঙ্গে ভারতে প্রতিষ্ঠিত সুলতানি রাষ্ট্রের সে অর্থে কোনো মিল নেই বলেই অনেকে মনে করেন। অর্থাৎ দিল্লির সুলতানরা সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে এদেশে রাজতন্ত্র গড়ে তুলেছিলেন।

মূল্যায়ন: দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র ধর্মাশ্রয়ী নাকি ধর্মনিরপেক্ষ ছিল এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো বেশ কঠিন। কারণ উভয়পক্ষের ঐতিহাসিকদের বক্তব্যের মধ্যে যথেষ্টই যুক্তি রয়েছে। তবে এ কথা সত্য যে, কোরানে বর্ণিত ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতে প্রতিষ্ঠিত সুলতানি রাষ্ট্রের সে অর্থে মিল ছিল না। আবার একে পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষও বলা যায় না। আসলে শক্তিশালী সেনাবাহিনী ও অভিজাত শ্রেণির ওপর সুলতানি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব অনেকাংশেই নির্ভরশীল ছিল। তাই ড. সতীশচন্দ্র সহ অনেকেই সুলতানি রাষ্ট্রকে সামরিক ও অভিজাততান্ত্রিক বলে ব্যাখ্যা করেছেন।

9. জিয়াউদ্দিন বরণীর ‘ফতওয়া-ই-জাহান্দারি’-তে রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রনীতি বিষয়ে কী ধারণা ছিল?

অথবা, জিয়াউদ্দিন বরণীর ‘ফতওয়া-ই-জাহান্দারি’ থেকে দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে কী জানা যায়?

Ans: ভূমিকা: জিয়াউদ্দিন বরণী ছিলেন সুলতানি যুগের একজন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও রাষ্ট্রনীতিবিদ। তিনি দীর্ঘকাল সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজসভার একজন গুরুত্বপূর্ণ সভাসদ ছিলেন। তাঁর এই দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি রচনা করেন তারিখ-ই-ফিরোজশাহী নামক বিখ্যাত গ্রন্থটি। এই গ্রন্থে তিনি সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন থেকে ফিরোজ শাহ তুঘলকের প্রথম ছয় বছরের রাজত্বকাল পর্যন্ত মোট আটজন সুলতানের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন। এই তারিখ-ই-ফিরোজশাহীর সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে তিনি রচনা করেন ফতওয়া-ই-জাহান্দারি। এই গ্রন্থে তিনি সুলতানি যুগের রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে বিশদে আলোচনা করেছেন।

[১) রাজতন্ত্র সম্পর্কে ধারণা:

(i) ঐশ্বরিক প্রতিষ্ঠান: জিয়াউদ্দিন বরণী তাঁর ফতওয়া-ই-জাহান্দারিতে রাজতন্ত্রকে একটি ঐশ্বরিক প্রতিষ্ঠান বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি দুই ধরনের রাজ্য বা রাজতন্ত্রের কথা বলেছেন, আল্লাহ বা ঈশ্বরের রাজ্য এবং ইহলোকের রাজ্য। তাঁর মতে, ঈশ্বরের রাজ্য হল আদর্শ রাজ্য। তিনি লিখেছেন, আল্লাহ বা ঈশ্বরই হলেন পার্থিব জগতের প্রকৃত শাসক এবং সকল ক্ষমতার উৎস। ঈশ্বর পার্থিব বা ইহলোকের জন্য শাসক (সুলতান) মনোনীত করেন। সুলতান বা শাসক হলেন তাঁর প্রতিনিধি মাত্র। তাই শাসক বা সুলতানকে তিনি ‘জিলুল্লাহ’ বা ঈশ্বরের ছায়া বলে উল্লেখ করেছেন।

(ii) বংশকৌলীন্য: বরণী তাঁর ফতওয়া-ই-জাহান্দারিতে সুলতানের বংশগত কৌলীন্যের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে, সুলতানের বংশকৌলীন্য থাকা একান্ত আবশ্যক। নতুবা তিনি প্রজাসাধারণের আনুগত্য ও শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারবেন না। তাঁর আচার-আচরণেও গাম্ভীর্য থাকা দরকার।

(iii) সাসানীয় রাজতন্ত্রের অনুকরণ: পারস্যের সাসানীয় রাজতন্ত্রকে বরণী আদর্শ ইসলামীয় রাজতন্ত্র বলে গণ্য করতেন। তিনি মনে করতেন পারস্য সম্রাটই ইসলামের আদর্শের প্রকৃত রক্ষক। তাই জাঁকজমকপূর্ণ সাসানীয় রাজতন্ত্রের অনুকরণেই দিল্লি সুলতানির রাজতন্ত্র গড়ে তোলা উচিত।

(iv) শাসকের ক্ষমতা ও মর্যাদা: বরণীর মতে, রাষ্ট্রে শাসক বা সুলতান হলেন চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। তিনি সব ধরনের বন্ধন থেকে মুক্ত। অর্থাৎ, তিনি একপ্রকার চরম রাজতন্ত্রকেই সমর্থন করেছেন। বরণী মনে করতেন, একজন শাসককে সবসময়ই কাফেরকে পরাজিত করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা উচিত। শাসক হবেন রাষ্ট্রে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। রাজসভায় তাঁর সামনে জনসভাসদদের নতজানু হওয়ার রীতি চালু রাখা উচিত। তাঁর মতে, এতে শাসকের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও মর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।

[২] রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে ধারণা:

(i) ইসলামীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠা: বরণী ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান। সেজন্য তিনি সুলতানদের ইসলামীয় আদর্শ অনুসরণে রাষ্ট্র পরিচালনার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি মনে করতেন, সুলতানি যুগে ভারতীয় মুসলিমরা ইসলামের মূল আদর্শ থেকে অনেকটাই বিচ্যুত হয়েছেন। তাই সুলতানের উচিত চূড়ান্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করে ইসলামের ভাবধারা ও আদর্শকে ফিরিয়ে আনা।

(ii) শরিয়তি বিধান অনুসরণ: বরণী তাঁর ফতওয়া-ই-জাহান্দারিতে বলেছেন, একজন শাসক বা সুলতান শরিয়তি আইন বা বিধান মেনেই রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। তবে তিনি এ কথাও স্বীকার করেছেন যে, ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় শরিয়তি আইনকে পুরোপুরিভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে তিনি আলাউদ্দিন খলজি ও কাজি মুঘিসুদ্দিনের কথোপকথনের একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন। আলাউদ্দিন খলজি কাজি মুঘিসুদ্দিনকে বলেছিলেন “কোল্টি শরিয়তের বিধিসম্মত বা বিধিসম্মত নয় তা আমি জানি না। রাষ্ট্রপক্ষে যা কল্যাণকর বা আপৎকালে যা জরুরি বলে মনে করি, আমি তাই করি।”

(iii) জাওয়াবিত বা রাষ্ট্রীয় আইন: বরণীর মতে, ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় যেহেতু শরিয়তি আইন পুরোপুরিভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়, তাই এখানে সুলতানকে ‘জাওয়াবিত’ বা রাষ্ট্রীয় আইন প্রবর্তন করতে হবে।

(iv) মন্ত্রণাসভা বা পরামর্শ পরিষদ গঠন: বরণী বলেছেন, যে-কোনো দক্ষ ও বিচক্ষণ শাসকের উচিত জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি ‘মন্ত্রণাসভা’ বা পরামর্শ পরিষদ গঠন করা। যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে শাসক এই সভার সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করবেন।

(v) শাসকের দায়িত্ব ও কর্তব্য: বরণীর মতে, শাসকের প্রধান কর্তব্য হল রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। এ ছাড়াও রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, প্রজাদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা, প্রজাকল্যাণ করাও শাসকের মূল দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে তিনি মনে করেন।

মূল্যায়ন: সবশেষে বলা যায় যে, বরণী ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। তাই তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্বে ধর্মীয় আদর্শের প্রভাবই বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। তিনি বলেছেন, “ধর্ম ছাড়া রাজনীতি অর্থহীন, আবার রাজনীতি ছাড়া ধর্ম অসহায়”। বরণী দিল্লি সুলতানি রাষ্ট্রকে জাহান্দারি বা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলবনের একটি উক্তির মধ্য দিয়ে দিল্লির সুলতানদের ধর্মনিরপেক্ষতার একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন। বলবন একবার বলেছিলেন, “আমার প্রভু ইলতুৎমিস প্রায়শই বলতেন যে, সুলতানের পক্ষে ধর্মবিশ্বাস মেনে কাজ করা সম্ভব নয়। আমার পক্ষে এটাই যথেষ্ট যে, তিনি ধর্মবিশ্বাস রক্ষা করতে সক্ষম।”

10. কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ এবং বরণীর ‘ফতওয়া-ই-জাহান্দারি’-তে রাজতন্ত্র ও রাজনীতি সম্বন্ধে ধারণা কী ছিল?

Ans: ভূমিকা: প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বহু মূল্যবান গ্রন্থ হল কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ড. শ্যাম শাস্ত্রী সংস্কৃত ভাষায় লেখা এই গ্রন্থটি আবিষ্কার করেন। এই গ্রন্থটির রচয়িতা সম্পর্কে বিতর্ক থাকলেও অধিকাংশ পণ্ডিত মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্য বা চাণক্যকেই অর্থশাস্ত্রের রচয়িতা বলে স্বীকার করেছেন। তবে পন্ডিতদের অনুমান বিভিন্ন যুগে গ্রন্থটি নানাভাবে পরিমার্জিত হয়েছে। অর্থশাস্ত্রের মূল বিষয়বস্তু রাষ্ট্রনীতি হলেও এই গ্রন্থটিতে মৌর্য যুগ তথা প্রাচীন ভারতের সমাজ, অর্থনীতি প্রভৃতি অন্যান্য বিষয়ও আলোচিত হয়েছে।

অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে ধারণা: অর্থশাস্ত্রে উল্লেখিত রাষ্ট্রনীতির বিভিন্ন দিকগুলি হল-

[১] শক্তিশালী ও বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র: অর্থশাস্ত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ না-থাকলেও কৌটিল্য মূলত শক্তিশালী ও বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রকেই সমর্থন করেছেন। তাঁর মতে, রাজা উচ্চবংশজাত হওয়াই ব্যঞ্ছনীয়। কেন-না বংশকৌলীন্যের কারণে সহজেই তিনি প্রজাসাধারণের আনুগত্য ও ভক্তিশ্রদ্ধা অর্জন করতে সক্ষম হবেন।

[২] রাষ্ট্রের সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব: কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’-এ বলা হয়েছে যে, মানবদেহের ন্যায় রাষ্ট্রেরও বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আছে। কৌটিল্যের মতে, রাষ্ট্র মূলত সাতটি অঙ্গ দ্বারা গঠিত। এগুলি হল- (i) স্বামী (রাজা), (ii) অমাত্য (আমলা গোষ্ঠী), (iii) জনপদ (রাষ্ট্র), (iv) দুর্গ (পুর-নগর), (v) কোশ (অর্থভাণ্ডার), (vi) দণ্ড (শাস্তিবিধান), এবং (vii) মিত্র (বন্ধু রাজা বা রাষ্ট্র)। এই সাতটি অঙ্গ রাষ্ট্রের ‘সপ্তাঙ্গতত্ত্ব’ নামে পরিচিত।

[৩] রাজার ক্ষমতা: কৌটিল্যের মতে, রাজা হলেন রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা। অর্থাৎ তিনিই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বা চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর কর্তৃত্ব ও আদেশকে উপেক্ষা বা অমান্য করার ক্ষমতা কারও নেই। তিনি রাষ্ট্রের সামরিক ও বেসামরিক শাসন এবং বিচারব্যবস্থার প্রধান। তবে অর্থশাস্ত্রে তাঁর অবাধ ও স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতাকে অবশ্য স্বীকার করা হয়নি। অর্থশাস্ত্রে, তাঁর সীমাহীন ক্ষমতার ওপর কিছু নিয়ন্ত্রণ আরোপের কথাও বলা হয়েছে। কৌটিল্যের মতে, রাজাই রাষ্ট্র নয়, তিনি এর অংশমাত্র।

[৪] রাজার কার্যাবলি: কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে রাজার গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। যথা- (i) কৌটিল্যের মতে, রাজার প্রধান কর্তব্য হল প্রজাদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করা। (ii) বহিঃশত্রুর আক্রমণ, নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়, রোগ-ব্যাধি, দস্যু-দুষ্কৃতীদের হাত থেকে প্রজাদের নিরাপত্তা বিধান করা। (iii) রাজার অন্যতম কাজ হল একটি সৎ ও দক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলা। (iv) শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাজাকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। (v) বৈদেশিক আক্রমণ ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার স্বার্থে দুর্গ ও নগর নির্মাণ করা।

[৫] রাজার গুণাবলি: কৌটিল্যের মতে, রাজাকে হতে হবে কূটনীতিপরায়ণ। সব ধরনের কাজের ক্ষেত্রেই রাজার মধ্যে থাকতে হবে উৎসাহ, উদ্দীপনা ও কর্মপ্রেরণা। রাজাকে হতে হবে সাহসী, ন্যায়পরায়ণ, ধর্মপরায়ণ, দৃঢ়চেতা, বিচক্ষণ ও সংযমী।

[৬] সুদক্ষ আমলাতন্ত্র গঠন: কৌটিল্যের মতে, রাজার একার পক্ষে রাষ্ট্রশাসন পরিচালনা করা সম্ভব নয়। এজন্য তিনি বিভিন্ন মন্ত্রী, অমাত্য ও অন্যান্য রাজকর্মচারীদের নিয়োগ করবেন এবং আমলাতন্ত্রের সাহায্যে রাজা শাসন পরিচালনা করবেন।

[৭] প্রজাকল্যাণকর রাষ্ট্র: কৌটিল্য তাঁর ‘অর্থশাস্ত্র’-এ প্রজাকল্যাণকর রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই সমর্থন করেছেন। তাঁর মতে, রাজাকে হতে হবে প্রজাদরদি। প্রজাসাধারণের মঙ্গলসাধন করাই তাঁর অন্যতম প্রধান কর্তব্য। নিজের সুখের থেকেও প্রজার সুখ রাজার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি বলেছেন, “প্রজার সুখেই রাজার সুখ, প্রজার হিতে (মঙ্গল) রাজার হিত” (প্রজাসুখে সুখং রাজ্ঞঃ প্রজানাং চ হিতে হিতম)।

[৮] বিচার ও আইনব্যবস্থা: রাজাই হলেন রাষ্ট্রে বিচার বিভাগের সর্বেসর্বা। রাষ্ট্রের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং অপরাধীকে দণ্ড বা শান্তিদান করা রাজার অন্যতম কর্তব্য বলে কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ করেছেন। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কঠোর আইন প্রণয়ন ও দণ্ডদানের পক্ষেই তিনি মত দিয়েছেন।

[৯] রাজস্বব্যবস্থা: কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে বলেছেন যে, সুষ্ঠুভাবে শাসন পরিচালনার জন্য রাজকোশ সমৃদ্ধ হওয়া দরকার। কেন-না, দুর্বল বা শূন্য রাজকোশ রাজা ও প্রজার উভয়েরই দুর্গতির অন্যতম মূল কারণ। তাই রাজস্ব নির্ধারণ, রাজস্ব সংগ্রহ ও বৃদ্ধির ব্যাপারে রাজাকে সর্বদাই নজর রাখতে হবে। রাষ্ট্রের রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য রাজাকে কৃষি, শিল্প ও ব্যাবসাবাণিজ্যের উন্নতির ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে। অর্থশাস্ত্রে তিনি সীতা, ভাগ ও বলি নামে তিনপ্রকার করের কথা উল্লেখ করেছেন।

[১০] গুপ্তচর ব্যবস্থা: মৌর্য শাসনব্যবস্থা আলোচনা প্রসঙ্গে কৌটিল্য গুপ্তচর ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন। কৌটিল্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ও বাইরে নানা খবরাখবর সংগ্রহের জন্য রাজাকে গুপ্তচর নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন।

[১১] ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা: কৌটিল্য রাষ্ট্রের আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় বিষয়ে পুরোহিতের কর্তৃত্বকে কৌটিল্য মেনে নিলেও রাজার ক্ষমতাকে প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা পুরোহিতের নেই। এমনকি পুরোহিত অপরাধ করলে তিনি তাঁদের চরম শাস্তির বিধান দিয়েছেন। বিচারক ও রাজকর্মচারীদের নিয়োগের আগে তাদের ধর্মনিরপেক্ষতাকে যাচাই-এর পরামর্শ দিয়েছেন।

[১] বরণীর ‘ফতওয়া-ই-জাহান্দারি’ রাজতন্ত্র সম্পর্কে ধারণা:

(i) ঐশ্বরিক প্রতিষ্ঠান: জিয়াউদ্দিন বরণী তাঁর ফতওয়া-ই-জাহান্দারিতে রাজতন্ত্রকে একটি ঐশ্বরিক প্রতিষ্ঠান বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি দুই ধরনের রাজ্য বা রাজতন্ত্রের কথা বলেছেন, আল্লাহ বা ঈশ্বরের রাজ্য এবং ইহলোকের রাজ্য। তাঁর মতে, ঈশ্বরের রাজ্য হল আদর্শ রাজ্য। তিনি লিখেছেন, আল্লাহ বা ঈশ্বরই হলেন পার্থিব জগতের প্রকৃত শাসক এবং সকল ক্ষমতার উৎস। ঈশ্বর পার্থিব বা ইহলোকের জন্য শাসক (সুলতান) মনোনীত করেন। সুলতান বা শাসক হলেন তাঁর প্রতিনিধি মাত্র। তাই শাসক বা সুলতানকে তিনি ‘জিলুল্লাহ’ বা ঈশ্বরের ছায়া বলে উল্লেখ করেছেন।

(ii) বংশকৌলীন্য: বরণী তাঁর ফতওয়া-ই-জাহান্দারিতে সুলতানের বংশগত কৌলীন্যের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে, সুলতানের বংশকৌলীন্য থাকা একান্ত আবশ্যক। নতুবা তিনি প্রজাসাধারণের আনুগত্য ও শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারবেন না। তাঁর আচার-আচরণেও গাম্ভীর্য থাকা দরকার।

(iii) সাসানীয় রাজতন্ত্রের অনুকরণ: পারস্যের সাসানীয় রাজতন্ত্রকে বরণী আদর্শ ইসলামীয় রাজতন্ত্র বলে গণ্য করতেন। তিনি মনে করতেন পারস্য সম্রাটই ইসলামের আদর্শের প্রকৃত রক্ষক। তাই জাঁকজমকপূর্ণ সাসানীয় রাজতন্ত্রের অনুকরণেই দিল্লি সুলতানির রাজতন্ত্র গড়ে তোলা উচিত।

(iv) শাসকের ক্ষমতা ও মর্যাদা: বরণীর মতে, রাষ্ট্রে শাসক বা সুলতান হলেন চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। তিনি সব ধরনের বন্ধন থেকে মুক্ত। অর্থাৎ, তিনি একপ্রকার চরম রাজতন্ত্রকেই সমর্থন করেছেন। বরণী মনে করতেন, একজন শাসককে সবসময়ই কাফেরকে পরাজিত করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা উচিত। শাসক হবেন রাষ্ট্রে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। রাজসভায় তাঁর সামনে জনসভাসদদের নতজানু হওয়ার রীতি চালু রাখা উচিত। তাঁর মতে, এতে শাসকের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও মর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।

[২] রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে ধারণা:

(i) ইসলামীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠা: বরণী ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান। সেজন্য তিনি সুলতানদের ইসলামীয় আদর্শ অনুসরণে রাষ্ট্র পরিচালনার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি মনে করতেন, সুলতানি যুগে ভারতীয় মুসলিমরা ইসলামের মূল আদর্শ থেকে অনেকটাই বিচ্যুত হয়েছেন। তাই সুলতানের উচিত চূড়ান্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করে ইসলামের ভাবধারা ও আদর্শকে ফিরিয়ে আনা।

(ii) শরিয়তি বিধান অনুসরণ: বরণী তাঁর ফতওয়া-ই-জাহান্দারিতে বলেছেন, একজন শাসক বা সুলতান শরিয়তি আইন বা বিধান মেনেই রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। তবে তিনি এ কথাও স্বীকার করেছেন যে, ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় শরিয়তি আইনকে পুরোপুরিভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে তিনি আলাউদ্দিন খলজি ও কাজি মুঘিসুদ্দিনের কথোপকথনের একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন। আলাউদ্দিন খলজি কাজি মুঘিসুদ্দিনকে বলেছিলেন “কোল্টি শরিয়তের বিধিসম্মত বা বিধিসম্মত নয় তা আমি জানি না। রাষ্ট্রপক্ষে যা কল্যাণকর বা আপৎকালে যা জরুরি বলে মনে করি, আমি তাই করি।”

(iii) জাওয়াবিত বা রাষ্ট্রীয় আইন: বরণীর মতে, ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় যেহেতু শরিয়তি আইন পুরোপুরিভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়, তাই এখানে সুলতানকে ‘জাওয়াবিত’ বা রাষ্ট্রীয় আইন প্রবর্তন করতে হবে।

(iv) মন্ত্রণাসভা বা পরামর্শ পরিষদ গঠন: বরণী বলেছেন, যে-কোনো দক্ষ ও বিচক্ষণ শাসকের উচিত জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি ‘মন্ত্রণাসভা’ বা পরামর্শ পরিষদ গঠন করা। যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে শাসক এই সভার সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করবেন।

(v) শাসকের দায়িত্ব ও কর্তব্য: বরণীর মতে, শাসকের প্রধান কর্তব্য হল রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। এ ছাড়াও রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, প্রজাদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা, প্রজাকল্যাণ করাও শাসকের মূল দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে তিনি মনে করেন।

11. টমাস ক্রমওয়েলের বিভিন্ন সংস্কারগুলি মূল্যায়ন করো। অথবা, টমাস ক্রময়েলের প্রশাসনিক ও ধর্মীয় সংস্কারগুলি বিশ্লেষণ করো।

Ans: ভূমিকা: টিউডর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সপ্তম হেনরির মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র অষ্টম হেনরি ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসেন। রাজা অষ্টম হেনরির মন্ত্রী ও প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন টমাস ক্রমওয়েল। তিনি ছিলেন একজন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ এবং দক্ষ প্রশাসক। তিনি নানা শাসনতান্ত্রিক পদক্ষেপ ও কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে টিউডর প্রশাসনকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন।

ক্রমওয়েলের প্রশাসনিক সংস্কার: অষ্টম হেনরির প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে টমাস ক্রমওয়েল নানা প্রশাসনিক সংস্কারসাধন করেছিলেন। যথা-

[১] সুদক্ষ আমলাতন্ত্র গঠন: টমাস ক্রমওয়েল ছিলেন একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দক্ষ প্রশাসক। তাই রাজার সচিব হিসেবে দায়িত্ব লাভের পরেই তিনি একটি সুদক্ষ আমলাতন্ত্র গঠনে সচেষ্ট হন। ইংরেজ ঐতিহাসিক জিওফ্রে এলটন বলেছেন, “টিউডর আমলে আমলাতান্ত্রিক কাঠামো প্রবর্তনের কৃতিত্ব টমাস ক্রমওয়েলের প্রাপ্য।”

[২] কেন্দ্রীয় প্রশাসনের পুনর্গঠন: সুদক্ষ আমলাতন্ত্র গঠনের পাশাপাশি ক্রমওয়েল কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থাকেও পুনর্গঠন করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি উনিশ জন কাউন্সিলরকে নিয়ে একটি প্রিভি কাউন্সিল গঠন করেন। এই প্রিভি কাউন্সিল নানা সরকারি কাজকর্ম পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকে। এ ছাড়াও তিনি সেক্রেটারি বা রাজার ব্যক্তিগত সচিব পদ সৃষ্টি করে সেই পদে নিজে বসেন।

[৩] অর্থনৈতিক সংস্কার: টমাস ক্রমওয়েল আর্থিক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর উদ্দেশ্যে ছয়টি পৃথক বিভাগ গঠন করেন। তিনি এই বিভাগগুলির মধ্যে যোগসূত্র রক্ষা করতেন। এই বিভাগগুলির মাধ্যমে তিনি প্রথাগত রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি চার্চ, সামন্তপ্রভুদের থেকে প্রাপ্য রাজস্ব আদায় করে রাজকোশকে সমৃদ্ধ করেছিলেন।

[৪] পার্লামেন্টের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা: টমাস ক্রমওয়েল ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের ক্ষমতা ও মর্যাদা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি পার্লামেন্ট কর্তৃক আইন প্রণয়ন ও কর অনুমোদনের ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করেন। তিনি সুকৌশলে অষ্টম হেনরিকে দিয়ে ঘোষণা করান যে, পার্লামেন্টে রাজার সার্বভৌম ক্ষমতা নিহিত আছে। তিনি পার্লামেন্টের সদস্যদের নানা অধিকার প্রদান করেন।

[৫] রাজার ক্ষমতা ও মর্যাদা বৃদ্ধি: টমাস ক্রমওয়েল এইভাবে নানা প্রশাসনিক সংস্কার ও পার্লামেন্টে বিভিন্ন আইন পাসের মধ্য দিয়ে রাজার ক্ষমতা ও মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। তিনি অষ্টম হেনরিকে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারীরূপে প্রতিষ্ঠিত করেন।

ধর্মীয় সংস্কারের বিভিন্ন দিক: টমাস ক্রমওয়েলের ধর্মসংস্কারের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল পোপের আধিপত্যকে ধ্বংস করা এবং রাষ্ট্রে অষ্টম হেনরির সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। এই উদ্দেশ্যে তিনি রিফর্মেশন পার্লামেন্ট গঠন করেন। এই পার্লামেন্টে নানা আইন পাসের মধ্য দিয়ে ইংল্যান্ডে ধর্মসংস্কারের পাশাপাশি অষ্টম হেনরির বিবাহবিচ্ছেদকে সুনিশ্চিত করা হয়।

[১] ‘অ্যাক্ট অফ সুপ্রিমেসি আইন’: টমাস ক্রমওয়েল রাজার ‘ভিকার জেনারেল’ বা মুখ্য ধর্মীয় প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হন (১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দ)। এরপর তিনি অ্যাক্ট অফ সুপ্রিমেসি (Act of Supremacy) নামে একটি আইন পাস করে ইংল্যান্ডের সকল চার্চকে রাজার নিয়ন্ত্রণাধীনে।- আনার চেষ্টা করেন। এই আইনে রাজাকে ইংল্যান্ডের চার্চের সুপ্রিম হেড বা সর্বময় প্রভু হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

[২] পোপের আধিপত্যের অবলুপ্তি: পার্লামেন্টে নানা আইন পাস করে ক্রমওয়েল ইংল্যান্ডের চার্চের ওপর পোপের কর্তৃত্বের অবলুপ্তি ঘটিয়ে রাজার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।

[৩] জাতীয় চার্চ প্রতিষ্ঠা: চার্চের ওপর রাজার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ক্রমওয়েল ইংল্যান্ডে জাতীয় চার্চ গঠন করেন। এইভাবে তাঁর নেতৃত্বে রোমান চার্চের সঙ্গে ইংল্যান্ডের সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটে।

[৪] মঠের বিলুপ্তি: ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ক্রমওয়েল পার্লামেন্টে আইন পাস করে ইংল্যান্ডের ছোটো ছোটো মঠগুলি উচ্ছেদ বা ধ্বংস করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল মঠগুলির সম্পত্তি আত্মসাৎ করা। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইংল্যান্ডে পিলগ্রিমেজ অফ গ্রেস নামে এক ধর্মীয় বিদ্রোহ দেখা দেয়। বিদ্রোহীরা ক্রমওয়েলের পদত্যাগের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠলে তিনি তাঁদের কঠোর হাতে দমন করেন। এরপর বড়ো মঠগুলির ওপর সম্রাটের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।

মূল্যায়ন: পরিশেষে বলা যায় যে, টমাস ক্রমওয়েল একের পর এক প্রশাসনিক সংস্কারের দ্বারা রাজতন্ত্র ও পার্লামেন্টের শক্তি ও মর্যাদাকে বহুগুণে বৃদ্ধি করেন। তিনি পার্লামেন্টের অভূতপূর্ব ক্ষমতা বৃদ্ধি করে পার্লামেন্টীয় বা সংসদীয় শাসনব্যবস্থার ভিত্তিপ্রতিষ্ঠা করেন। তা ছাড়া চার্চের ওপর রাজার কর্তৃত্ব বা সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে তিনি ইংল্যান্ডে ধর্মসংস্কারের পথকে প্রশস্ত করেন। ঐতিহাসিক ডেভিস বলেছেন, “অষ্টম হেনরির ধর্মসংস্কার রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও মর্যাদা বৃদ্ধি করেছিল।” কিন্তু অষ্টম হেনরির দ্বিতীয় বিবাহ ভেঙে যাওয়ায় এবং তাঁর কিছু প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে রাজা ক্রমওয়েলের প্রতি ক্ষুব্ধ হন। শেষপর্যন্ত অষ্টম হেনরি রাজদ্রোহের অপরাধে তাঁকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করেন (১৫৪০ খ্রিস্টাব্দ)। তথাপি, ইংল্যান্ডে আধুনিক শাসনতান্ত্রিক কাঠামো গঠন ও বিকাশে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়।

12. ইক্তা কী? ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলে ইক্তা ব্যবস্থার কী কী পরিবর্তন ঘটে?

Ans: ভূমিকা: মধ্যযুগে ভারতে সুলতানি শাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল ইক্তা ব্যবস্থা। ইসলামের আবির্ভাবের প্রায় সূচনাকাল থেকেই ইসলামীয় জগতে এই ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। ঐতিহাসিক কে এম আশরাফ বলেছেন, সম্ভবত খলিফা মুকতিদির এই প্রথার উদ্ভাবক ছিলেন। তবে ভারতে এই প্রথার প্রবর্তক ছিলেন সুলতান ইলতুৎমিস। তাঁর পরবর্তী সুলতানদের আমলে ইক্তা ব্যবস্থার মধ্যে নানা পরিবর্তন ও সংযোজন ঘটেছিল।

ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলে ইক্তা ব্যবস্থা: সুলতান হিসেবে ফিরোজ শাহ তুঘলক ছিলেন যথেষ্ট উদার ও দুর্বল চিত্ত। তাই তিনি সিংহাসনে বসে অভিজাত শ্রেণিকে নানা ধরনের সুযোগসুবিধা দিয়েছিলেন। ফলে ইক্তা ব্যবস্থায় নানা পরিবর্তন ঘটে। যেমন – N

(i) তাঁর আমলে ইক্তা ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ে।

(ii) তিনি অভিজাতদের ব্যাপক হারে ইক্তা বিলি করায় ‘খালিসা’ জমির পরিমাণ হ্রাস পায়। ফলে ফিরোজ শাহ তুঘলক রাজকীয় আয় কমে যায়। এটি সুলতানি সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়।

(iii) ইক্তা ব্যবস্থাকে তিনি বংশানুক্রমিক করে দেন।

(iv) তাঁর আমলে ইক্তার হিসাবপরীক্ষার বিষয়টি ক্রমশ শিথিল হয়ে পড়ে।

(v) ফিরোজ শাহ তুঘলক সেনাদের নগদ বেতন দেওয়ার পরিবর্তে গ্রামের খাজনা আদায় করার অধিকার দেন। একে বলা হত ওয়াঝ। ঐতিহাসিক আফিফ বলেছেন, ফিরোজ শাহ সমস্ত রাজস্ব, ইত্তা এবং পরগনাগুলি জনগণের মধ্যে বণ্টন করে দেন।

13. মনসবদারি ব্যবস্থা কী? এর বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো। 

Ans: ভূমিকা: মোগল সম্রাট আকবর ছিলেন শাসক হিসেবে অত্যন্ত দক্ষ, বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। তাঁর নেতৃত্বেই ভারতে এক বিশাল মোগল সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। সাম্রাজ্য গঠনের পাশাপাশি তিনি মোগল শাসনকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি নানা শাসনতান্ত্রিক পরীক্ষানিরীক্ষা ও প্রশাসনিক সংস্কার করেছিলেন। তাঁর এই প্রশাসনিক সংস্কারগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ছিল মনসবদারি প্রথার প্রবর্তন। –

মনসবদারি প্রথার বৈশিষ্ট্য: আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরি ও সপ্তদশ শতকের কিছু গ্রন্থ থেকে মনসবদারি প্রথা সম্পর্কে বহু তথ্য জানা যায়। এইসকল তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই মনসবদারি প্রথার কতকগুলি গরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন আব্দুল আজিজ, শিরিন মুসভি, আতাহার আলি, সতীশচন্দ্র, ইরফান হাবিব প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ। আকবর প্রবর্তিত মনসবদারি প্রথার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল-

[১] ‘মনসব’ ও ‘মনসবদার’: ‘মনসবদার’ কথাটির উৎপত্তি আরবি ‘মনসব’ শব্দ থেকে। মনসব শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল ‘পদমর্যাদা’ (Rank)। এই পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিরা ‘মনসবদার’ নামে পরিচিত। – এই অর্থে মোগল প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত উচ্চ পদাধিকারী ব্যক্তিদের ‘মনসবদার’ বলা হয়।

[২] স্তরবিন্যাস প্রথা: ‘আইন-ই-আকবরি’তে মনসবদারদের ৬৬টি স্তরের কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু বাস্তবে পদমর্যাদা অনুযায়ী তাঁদের ৩৩টি স্তরের কথা জানা যায়। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক অনিল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন-“আকবর সম্ভবত ৬৬টি স্তরের পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু বাস্তবে ৩৩টি স্তর গঠন করতে পেরেছিলেন।” সর্বনিম্ন মনসবদারের অধীনে ১০ জন, সর্বোচ্চ মনসবদারের অধীনে ৫ হাজার সৈন্য থাকত। তবে মানসিংহ, টোডরমল, কুলিচ খাঁ প্রমুখ আকবরের বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিরা সাত হাজারি মনসব দ্বারা সম্মানিত হয়েছিলেন। এমনকি সম্রাটের নিকট আত্মীয়দের কেউ কেউ দশ হাজারি বা তারও বেশি মনসবদারের পদ পেতেন।

[৩] জাট ও সওয়ার: মনসবদারি প্রথার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবেই যুক্ত ছিল ‘জাট’ ও ‘সওয়ার’ নামক দুটি পদ। কিন্তু এই দুটি পদের অর্থ বা ব্যাখ্যা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে নানা বিতর্ক আছে। ঐতিহাসিক আরভিন, ঈশ্বরী প্রসাদ, অনিরুদ্ধ রায় প্রমুখরা মনে করেন যে, ‘জাট’ পদ দ্বারা মনসবদারের ব্যক্তিগত পদমর্যাদা ও বেতনকে বোঝায়। আর সওয়ার ছিল তাঁর অধীনে থাকা অশ্বারোহী বাহিনীর সংখ্যা। আবার অনেকের মতে, জাট ও সওয়ার পদ দুটি ছিল যথাক্রমে পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনীর সূচক।

[৪] নিয়োগ, বদলি ও পদচ্যুতি: আকবরের আমল থেকেই মনসবদারদের নিয়োগ বদলি, পদোন্নতি ও পদচ্যুতি সব কিছুই ছিল সম্রাটের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। মনসবদারদের নিয়োগ করা হত যোগ্যতার ভিত্তিতে, বংশানুক্রমিকভাবে নয়। কোনো মনসবদার সঠিকভাবে তাঁর দায়িত্ব বা কর্তব্য পালন করতে না-পারলে সম্রাট যে-কোনো সময় তাঁকে বদলি কিংবা পদচ্যুত করতে পারতেন।

[৫] বেতন ব্যবস্থা: মনসবদারদের দু-ভাবে বেতন দেওয়া হত। যেসকল মনসবদার নগদ টাকায় (দাম) বেতন পেতেন তাঁদের বলা হত মনসবদার-ই-নগদি। আর যাঁরা বেতন বাবদ জমি বরাদ্দ পেতেন, তাঁদের বলা হত ‘জায়গিরদার’।

[৬] দাগ ও চেহরা প্রথা: মনসবদারদের অনেকেই ছিলেন অসৎ ও সুযোগসন্ধানী। অনেক সময়ই তাঁরা নির্দিষ্টসংখ্যক সৈন্য ও অশ্ব রাখতেন না। সেনাবাহিনীর মধ্যে এই দুর্নীতি রোধ করার জন্য আকবর ‘দাগ’ ও ‘চেহরা’ প্রথা চালু করেন।

[৭] সামরিক ও বেসামরিক দায়িত্ব পালন: পদমর্যাদা অনুযায়ী প্রত্যেক মনসবদারকেই তাঁদের নির্দিষ্টসংখ্যক পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনী পোষণ করতে হত। যুদ্ধের সময়ে তাঁরা সম্রাটকে এই সৈন্যবাহিনী দিয়ে সাহায্য করতে বাধ্য থাকতেন। মনসবদারদের সামরিক সাহায্যের পাশাপাশি নানা বেসামরিক কাজ বা দায়িত্বও পালন করতে হত।

14. অর্থশাস্ত্রের মূল বিষয়বস্তু কী ছিল? অথবা, কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ সম্পর্কে কী জান?

Ans: ভূমিকা: প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রনীতি-বিষয়ক একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান গ্রন্থ হল ‘অর্থশাস্ত্র’। মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্য বা চাণক্যকেই অধিকাংশ পণ্ডিত অর্থশাস্ত্রের রচয়িতা বলে স্বীকার করেছেন। তবে এই গ্রন্থটি বিভিন্ন যুগে নানাভাবে পরিমার্জিত হয়েছে বলে পন্ডিতদের অনুমান। অর্থশাস্ত্রে মৌর্য যুগ তথা প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রনীতি, সমাজ, অর্থনীতি প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে।

[১] আবিষ্কার: ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে মহীশূরের পণ্ডিত ড. আর শ্যাম শাস্ত্রী সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থটি আবিষ্কার করেন। তবে মূল গ্রন্থটির কিছু অংশ অবশ্য পাওয়া যায়নি। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় এবং পরবর্তীকালে ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়।

[২] রচনাকাল: কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের রচনাকাল সম্পর্কেও পন্ডিতদের মধ্যে নানা বিতর্ক রয়েছে। তবে অধিকাংশ পণ্ডিত মনে করেন যে, যেহেতু কৌটিল্য বা চাণক্য ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী, তাই অর্থশাস্ত্রের রচনাকাল খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী।

[৩] অর্থশাস্ত্রের বিষয়বস্তু: অর্থশাস্ত্রের মূল বিষয়বস্তু হল রাষ্ট্রনীতি। কৌটিল্য এই গ্রন্থে মৌর্য যুগ তথা প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রনীতির বিভিন্ন দিক, যথা-শাসন, আইন, বিচারব্যবস্থা, রাজার দায়িত্ব-কর্তব্য, অর্থনীতি ইত্যাদি নানা বিষয়ে তাঁর মতামত লিপিবদ্ধ করেছেন। ‘অর্থশাস্ত্র’-এ ১৫টি অধিকরণ, ১৫০টি অধ্যায়, ১৮০টি প্রকরণ এবং প্রায় ৬ হাজার শ্লোক আছে। অর্থশাস্ত্রের প্রথম অধিকরণে রাজার বিভিন্ন কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের বিষয়, দ্বিতীয় অধিকরণে মন্ত্রী ও অন্যান্য কর্মচারীদের নিয়োগ এবং তৃতীয় ও চতুর্থ অধিকরণে ফৌজদারি, দেওয়ানি এবং ব্যক্তিগত আইন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। পঞ্চম অধিকরণে উল্লেখিত হয়েছে অমাত্যসহ বিভিন্ন রাজকর্মচারিদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। ষষ্ঠ অধিকরণে রাষ্ট্রের ‘সপ্তাঙ্গতত্ত্ব’ এবং সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ অধিকরণে পররাষ্ট্রনীতি, যুদ্ধ ও শান্তি এবং যুদ্ধবিদ্যার বিভিন্ন দিক আলোচিত হয়েছে। শেষ অধিকরণ দুটিতে প্রধানত তন্ত্রমন্ত্র সম্পর্কে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

মূল্যায়ন: সবশেষে বলা যায় যে, প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত একটি নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হল কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’। এই গ্রন্থে মৌর্য যুগের শাসন, আইন, বিচার এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বর্ণনার মধ্য দিয়ে কৌটিল্য প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রনীতির বিভিন্ন দিকগুলি তুলে ধরেছেন। রাষ্ট্রনীতি চর্চায় অসামান্য অবদানের জন্য তাই অনেকেই তাঁকে ‘ভারতের ম্যাকিয়াভেলি’ বলে অভিহিত করেন।

15. ‘অর্থশাস্ত্র’-এ বর্ণিত রাষ্ট্রের সপ্তাঙ্গতত্ত্ব সম্পর্কে কী জান?

Ans: ভূমিকা: কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে বলেছেন যে, মানবদেহের ন্যায় রাষ্ট্রেরও বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আছে। তাঁর মতে, রাষ্ট্র মূলত সাতটি অঙ্গ দ্বারা গঠিত। এগুলি হল-স্বামী, অমাত্য, জনপদ, দুর্গ, কোশ, দণ্ড এবং মিত্র। এটি কৌটিল্যের সপ্তাঙ্গতত্ত্ব নামে পরিচিত।

[১] স্বামী: সাধারণভাবে ‘স্বামী’ শব্দটি প্রভু বা প্রধান অর্থে বিভিন্ন প্রাচীন শাস্ত্রে উল্লিখিত হয়েছে। তবে কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে স্বামী বলতে ‘রাজা’ অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রধানকেই বুঝিয়েছেন। কৌটিল্যের মতে, রাষ্ট্রের সাতটি উপাদানের মধ্যে স্বামী বা রাজাই হলেন সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কারণ তিনি রাষ্ট্রের প্রধান বা সর্বেসর্বা।

[২] অমাত্য: কৌটিল্য রাষ্ট্রের অন্যতম অঙ্গ হিসেবে অমাত্যদের কথা বলেছেন। অর্থশাস্ত্রে ‘অমাত্য’ বলতে উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী বা আমলাদের বোঝানো হয়েছে। এই সমস্ত রাজকর্মচারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-পুরোহিত, প্রদেষ্টা, রাজদূত, বিচারক, কোশাধক্ষ্য, সমাহর্তা প্রমুখ।

[৩] জনপদ: ‘জনপদ’ বলতে সাধারণত জনবসতিপূর্ণ ভূখণ্ড বা এলাকাকে বোঝায়। প্রাচীন ভারতীয় বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্রে ‘জনপদ’ অর্থে ‘রাষ্ট্র’ কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। কৌটিল্য আবার জনপদ শব্দটির দ্বারা নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ও জনসমষ্টি উভয়কেই বুঝিয়েছেন। তাঁর মতে, ভূখণ্ড ও জনগণ ছাড়া রাষ্ট্র অস্তিত্বহীন।

[৪] দুর্গ: ‘অর্থশাস্ত্র’-এ বলা হয়েছে রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল দুর্গ। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে দুর্গনিবেশ-শীর্ষক অধ্যায়ে চার ধরনের দুর্গের কথা উল্লেখিত হয়েছে। এগুলি হল-পার্বত্য (গিরি) দুর্গ, জলদুর্গ, মরুদুর্গ, এবং অরণ্যদুর্গ।

[৫] কোশ: কৌটিল্য রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে ‘কোশ’-এর কথা বলেছেন। কোশ বলতে কৌটিল্য রাজকোশ অর্থাৎ রাজার অর্থভাণ্ডারকে বুঝিয়েছেন। তাঁর মতে, রাজাকে সর্বদাই রাজকোশ সমৃদ্ধশালী হওয়ার ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে। সেজন্য রাজাকে ভূমির রাজস্বের পাশাপাশি অন্যান্য রাষ্ট্রীয় কর আদায়ের ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে।

[৬] দণ্ড: ‘দণ্ড’ শব্দের সমার্থক শব্দ বল। অবশ্য কৌটিল্য দণ্ড বলতে মূলত সেনাবাহিনীকে বুঝিয়েছেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের শক্তি ও স্থায়িত্ব অনেকটাই সামরিক বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল। এই দণ্ড বা সেনাবাহিনী মূলত পদাতিক, অশ্বারোহী, রথ ও হস্তিবাহিনী নিয়ে গঠিত। তাঁর মতে, দণ্ড দ্বারা রাজা দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করবেন।

[৭] মিত্র: রাষ্ট্রের সর্বশেষ অঙ্গ হল ‘মিত্র’। কৌটিল্য বলেছেন মিত্র সাধারণত দুই ধরনের হয়-সহজ বা স্বাভাবিক মিত্র এবং অর্জিত বা কৃত্রিম মিত্র। তিনি তাকেই স্বাভাবিক মিত্র বলেছেন, যে রাজা বা রাজ্য বংশপরম্পরায় বন্ধুভাবাপন্ন। আবার বিজিত রাজার সঙ্গেও মিত্রতার বন্ধনের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন।

মূল্যায়ন: পরিশেষে বলা যায় যে, কৌটিল্যের রাষ্ট্রনীতি তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক সপ্তাঙ্গতত্ত্ব। রাষ্ট্র যে বিভিন্ন অঙ্গের সমন্বয়ে গঠিত, এই তত্ত্বের মধ্য দিয়ে কৌটিল্য তা অসাধারণভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। অনেকের মতে, স্বামী বা রাজা হলেন রাষ্ট্রের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ এবং মিত্র হল তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।

16. বরণীর ‘ফতওয়া-ই-জাহান্দারি’-তে রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে কী ধারণা ছিল?

Ans: রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে ধারণা:

(i) ইসলামীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠা: বরণী ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান। সেজন্য তিনি সুলতানদের ইসলামীয় আদর্শ অনুসরণে রাষ্ট্র পরিচালনার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি মনে করতেন, সুলতানি যুগে ভারতীয় মুসলিমরা ইসলামের মূল আদর্শ থেকে অনেকটাই বিচ্যুত হয়েছেন। তাই সুলতানের উচিত চূড়ান্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করে ইসলামের ভাবধারা ও আদর্শকে ফিরিয়ে আনা।

(ii) শরিয়তি বিধান অনুসরণ: বরণী তাঁর ফতওয়া-ই-জাহান্দারিতে বলেছেন, একজন শাসক বা সুলতান শরিয়তি আইন বা বিধান মেনেই রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। তবে তিনি এ কথাও স্বীকার করেছেন যে, ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় শরিয়তি আইনকে পুরোপুরিভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে তিনি আলাউদ্দিন খলজি ও কাজি মুঘিসুদ্দিনের কথোপকথনের একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন। আলাউদ্দিন খলজি কাজি মুঘিসুদ্দিনকে বলেছিলেন “কোল্টি শরিয়তের বিধিসম্মত বা বিধিসম্মত নয় তা আমি জানি না। রাষ্ট্রপক্ষে যা কল্যাণকর বা আপৎকালে যা জরুরি বলে মনে করি, আমি তাই করি।”

(iii) জাওয়াবিত বা রাষ্ট্রীয় আইন: বরণীর মতে, ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় যেহেতু শরিয়তি আইন পুরোপুরিভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়, তাই এখানে সুলতানকে ‘জাওয়াবিত’ বা রাষ্ট্রীয় আইন প্রবর্তন করতে হবে।

(iv) মন্ত্রণাসভা বা পরামর্শ পরিষদ গঠন: বরণী বলেছেন, যে-কোনো দক্ষ ও বিচক্ষণ শাসকের উচিত জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি ‘মন্ত্রণাসভা’ বা পরামর্শ পরিষদ গঠন করা। যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে শাসক এই সভার সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করবেন।

(v) শাসকের দায়িত্ব ও কর্তব্য: বরণীর মতে, শাসকের প্রধান কর্তব্য হল রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। এ ছাড়াও রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, প্রজাদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা, প্রজাকল্যাণ করাও শাসকের মূল দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে তিনি মনে করেন।

মূল্যায়ন: সবশেষে বলা যায় যে, বরণী ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। তাই তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্বে ধর্মীয় আদর্শের প্রভাবই বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। তিনি বলেছেন, “ধর্ম ছাড়া রাজনীতি অর্থহীন, আবার রাজনীতি ছাড়া ধর্ম অসহায়”। বরণী দিল্লি সুলতানি রাষ্ট্রকে জাহান্দারি বা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলবনের একটি উক্তির মধ্য দিয়ে দিল্লির সুলতানদের ধর্মনিরপেক্ষতার একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন। বলবন একবার বলেছিলেন, “আমার প্রভু ইলতুৎমিস প্রায়শই বলতেন যে, সুলতানের পক্ষে ধর্মবিশ্বাস মেনে কাজ করা সম্ভব নয়। আমার পক্ষে এটাই যথেষ্ট যে, তিনি ধর্মবিশ্বাস রক্ষা করতে সক্ষম।”

17. চিনের ম্যান্ডারিন ব্যবস্থা সম্পর্কে টীকা লেখো।

Ans: ভূমিকা: প্রাচীন কাল থেকেই চিনা সম্রাট ছিলেন রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তবে শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার জন্য তিনি বিভিন্ন প্রশাসনিক দপ্তর এবং একটি সুদক্ষ আমলাতন্ত্র গড়ে তুলেছিলেন। চিনা প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত আমলা বা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীরা সাধারণভাবে ম্যান্ডারিন নামে পরিচিত ছিলেন।

[১] উদ্ভব: চিনে নানা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে একটি আমলাতান্ত্রিক শাসনকাঠামো গড়ে উঠেছিল। প্রাচীন তাং বংশের শাসনকাল (৬১৮-৯০৭ খ্রিস্টাব্দ) চিনে একটি নতুন ধরনের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এই আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রশাসনে এক নতুন ধরনের আমলা বা সরকারি কর্মচারীর আবির্ভাব ঘটে। এঁরাই ম্যান্ডারিন নামে পরিচিত।

[২] যোগ্যতা ও কার্যাবলি: ম্যান্ডারিন পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সম্পত্তি বা বংশকৌলীন্য নয় বরং কনফুসীয় আদর্শ, সাহিত্য, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা প্রভৃতি বিষয়ে তাঁদের জ্ঞান কতটুকু তা যাচাই করা হত। এইসকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ব্যক্তিদের কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক প্রশাসনে সরকারি কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ করা হত। উচ্চপদস্থ ম্যান্ডারিনরা সম্রাটকে প্রশাসনের নানা কাজে সাহায্য করতেন। মধ্য ও নিম্নস্তরের ম্যান্ডারিনরা প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক স্তরের স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতেন। তাঁদের জীবনযাত্রা ছিল বেশ বিলাসবহুল।

[৩] ত্রুটি: ম্যান্ডারিনরা ক্রমশ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কঠোর শ্রমের তুলনায় তাঁদের বেতন ছিল কম। তাই তাঁরা আর্থিক ব্যাপারে দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করতেন। এই ব্যবস্থার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি ছিল স্বজনপোষণ। এইসকল কারণে ম্যান্ডারিনরা জনগণের শ্রদ্ধা হারিয়েছিলেন।

গুরত্ব: চিনের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ম্যান্ডারিনদের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চিনের প্রশাসনিক সাফল্য অনেকটা তাঁদের ওপরই নির্ভরশীল ছিল। তাঁরা ছিলেন কেন্দ্র ও আঞ্চলিক শাসনের যোগসূত্রকারী। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ চিনে কিং বংশের পতনের সঙ্গে সঙ্গে এই ব্যবস্থার অবসান ঘটে।

18. ইত্তা ব্যবস্থা বলতে কী বোঝ?

অথবা, ‘ইত্তা ব্যবস্থা’ সম্পর্কে টাকা লেখো।

Ans: ভূমিকা: ইসলামীয় বিধান অনুসারে কৃষকদের উৎপাদনের এ উদ্বৃত্তের একাংশ রাষ্ট্রের প্রাপ্য বলে বিবেচিত হত। কৃষকদের এই উৎপাদনের উদ্বৃত্তের একাংশ সংগ্রহ করা এবং তা শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে বিলিবণ্টন করার পদ্ধতিকে সাধারণভাবে ইত্তা প্রথা বলা হয়। ভারতে প্রচলনের বহুকাল আগে থেকে ইসলামীয় জগতে এই প্রথা প্রচলিত ছিল। দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিস ভারতে প্রথম এই প্রথার প্রচলন করেন।

[১] অর্থ: ‘ইক্তা’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল ‘এক অংশ’ বা ‘এলাকা’। কিন্তু আসলে এটি ছিল এক ধরনের ভূমিদান ও ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্ত ব্যবস্থা। দিল্লির সুলতানরা নববিজিত অঞ্চলগুলি থেকে রাজস্ব আদায় ও দূরবর্তী অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তাঁদের বিশ্বস্ত সেনাপতি, সৈনিক কিংবা অভিজাতদের জমি বা এলাকা বণ্টন করতেন। এই জমি বা এলাকা ‘ইক্তা’ নামে পরিচিত। ইক্তার মালিক ‘ইক্তাদার’, ‘মাক্তি’, ‘ওয়ালি’ বা ‘উলিয়াৎ’ প্রভৃতি বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিলেন।

[২] উদ্দেশ্য: দিল্লির প্রথমদিকে সুলতানরা একাধিক উদ্দেশ্যে এই ব্যবস্থা চালু করেন। যথা- (i) নববিজিত এলাকাগুলি থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করা। (ii) দূরবর্তী এলাকা বা প্রদেশগুলির ওপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। (iii) ইক্তাগুলিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও শান্তিপ্রতিষ্ঠা করা।

[৩] বৈশিষ্ট্য: সুলতানি আমলে প্রচলিত ইক্তা ব্যবস্থার কতকগুলি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা যায়, যথা-

(i) ইক্তা থেকে ইক্তাদারদের রাজস্ব সংগ্রহ করতে হত এবং উদ্‌বৃত্ত রাজস্ব ইক্তাদারদের রাজকোশে পাঠাতে হত।

(ii) ইক্তার আয় থেকে মাক্তিদের সৈন্যবাহিনী পোষণ করতে হত। সুলতানের প্রয়োজনে তাঁদের সেই সেনাবাহিনী দিয়ে সাহায্য করতে হত।

(iii) ইক্তাদারদের স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হত।

(iv) সুলতানরা ইক্তাদারদের বদলি, এমনকি তাদের ইক্তা বাজেয়াপ্ত করতে পারতেন।

মূল্যায়ন: ইক্তা ব্যবস্থা ছিল সুলতানি আমলের প্রাদেশিক শাসনের মূলভিত্তি। এই ব্যবস্থা দ্বারা সুলতানরা অভিজাত শ্রেণিকে সন্তুষ্ট করার পাশাপাশি দূরবর্তী অঞ্চলে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করেছিলেন।

Class 11 First (1st) Unit Test Question and Answer :

Class 11 Second (2nd) Unit Test Question and Answer :

Class 11 Suggestion – একাদশ শ্রেণীর সাজেশন

আরোও দেখুন:-

Class 11 Bengali Suggestion Click here

আরোও দেখুন:-

Class 11 English Suggestion Click here

আরোও দেখুন:-

Class 11 Geography Suggestion Click here

আরোও দেখুন:-

Class 11 History Suggestion Click here

আরোও দেখুন:-

Class 11 Political Science Suggestion Click here

আরোও দেখুন:-

Class 11 Education Suggestion Click here

আরোও দেখুন:-

Class 11 Philosophy Suggestion Click here

আরোও দেখুন:-

Class 11 Sociology Suggestion Click here

আরোও দেখুন:-

Class 11 Sanskrit Suggestion Click here

আরোও দেখুন:-

Class 11 All Subjects Suggestion Click here

◆ একাদশ শ্রেণীর পরীক্ষার প্রস্তুতি, বিনামূল্যে নোটস, সাজেশন, PDF ও সমস্ত আপডেটের জন্য আমাদের WhatsApp Group এ Join হয়ে যাও।

Class 11 WhatsApp Groups Click Here to Join

একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর | West Bengal Class 11th History Question and Answer / Suggestion / Notes Book

আরোও দেখুন :-

একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস সমস্ত অধ্যায়ের প্রশ্নউত্তর Click Here

FILE INFO : রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর | Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer with FREE PDF Download Link

PDF File Name রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর | Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer PDF
Prepared by Experienced Teachers
Price FREE
Download Link  Click Here To Download
Download PDF Click Here To Download

রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) অধ্যায় থেকে আরোও প্রশ্ন ও উত্তর দেখুন :

  • রাষ্ট্রের প্রকৃতি – একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর (Mark-4) Click here
  • রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর (Mark-6/8) Click here

[আরও দেখুন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন রচনা – Rabindranath Tagore Biography in Bengali]

[আমাদের YouTube চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন Subscribe Now]

Info : রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস সাজেশন প্রশ্ন ও উত্তর

 Class 11 History Suggestion | West Bengal WBCHSE Class Eleven XI (Class 11th) History Question and Answer Suggestion 

” রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন উত্তর “ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ টপিক একাদশ শ্রেণীর পরীক্ষা (West Bengal Class Eleven XI / WB Class 11 / WBCHSE / Class 11 Exam / West Bengal Council of Higher Secondary Education – WB Class 11 Exam / Class 11th / WB Class 11 / Class 11 Pariksha ) এখান থেকে প্রশ্ন অবশ্যম্ভাবী । সে কথা মাথায় রেখে Bhugol Shiksha .com এর পক্ষ থেকে একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস পরীক্ষা প্রস্তুতিমূলক সাজেশন এবং প্রশ্ন ও উত্তর ( একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস সাজেশন / একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ও উত্তর । Class-11 History Suggestion / Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer / Class 11 History Suggestion / Class-11 Pariksha History Suggestion / History Class 11 Exam Guide / MCQ , Short , Descriptive Type Question and Answer / Class 11 History Suggestion FREE PDF Download) উপস্থাপনের প্রচেষ্টা করা হলাে। ছাত্রছাত্রী, পরীক্ষার্থীদের উপকারে লাগলে, আমাদের প্রয়াস একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস পরীক্ষা প্রস্তুতিমূলক সাজেশন এবং প্রশ্ন ও উত্তর (Class 11 History Suggestion / West Bengal Eleven XI Question and Answer, Suggestion / WBCHSE Class 11th History Suggestion / Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer / Class 11 History Suggestion / Class 11 Pariksha Suggestion / Class 11 History Exam Guide / Class 11 History Suggestion 2025, 2026, 2027, 2028, 2029, 2030 / Class 11 History Suggestion MCQ , Short , Descriptive Type Question and Answer. / Class-11 History Suggestion FREE PDF Download) সফল হবে।

রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) প্রশ্ন ও উত্তর 

রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) প্রশ্ন ও উত্তর | রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer Suggestion একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) প্রশ্ন ও উত্তর।

রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) MCQ প্রশ্ন ও উত্তর | একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস 

রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) MCQ প্রশ্ন ও উত্তর | রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer Suggestion একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) MCQ প্রশ্ন উত্তর।

রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) SAQ সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর | একাদশ শ্রেণির ইতিহাস 

রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) SAQ সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর | রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer Suggestion একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) SAQ সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর।

রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) MCQ প্রশ্ন উত্তর – একাদশ শ্রেণি ইতিহাস | Class 11 History Rastrer Prokriti 

একাদশ শ্রেণি ইতিহাস (Class 11 History Rastrer Prokriti) – রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) প্রশ্ন ও উত্তর | রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) | Class 11 History Rastrer Prokriti Suggestion একাদশ শ্রেণি ইতিহাস – রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) প্রশ্ন উত্তর।

একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর | একাদশ শ্রেণির ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) প্রশ্ন উত্তর | Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer Question and Answer, Suggestion 

একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) | একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) | পশ্চিমবঙ্গ একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) | একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস সহায়ক – রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) প্রশ্ন ও উত্তর । Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer, Suggestion | Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer Suggestion | Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer Notes | West Bengal Class 11th History Question and Answer Suggestion.

একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) MCQ প্রশ্ন উত্তর | WBCHSE Class 11 History Question and Answer, Suggestion 

একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) প্রশ্ন উত্তর প্রশ্ন ও উত্তর | রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) । Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer Suggestion.

WBCHSE Class 11th History Rastrer Prokriti Suggestion | একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়)

WBCHSE Class 11 History Rastrer Prokriti Suggestion একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) প্রশ্ন উত্তর প্রশ্ন ও উত্তর । রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) | Class 11 History Rastrer Prokriti Suggestion একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) প্রশ্ন উত্তর প্রশ্ন ও উত্তর ।

Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer Suggestions | একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) | একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর 

Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) MCQ, সংক্ষিপ্ত, রোচনাধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর ।

WB Class 11 History Rastrer Prokriti Suggestion | একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) MCQ প্রশ্ন উত্তর প্রশ্ন ও উত্তর 

Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer Suggestion একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর – রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) MCQ প্রশ্ন ও উত্তর । Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer Suggestion একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর।

West Bengal Class 11 History Suggestion Download WBCHSE Class 11th History short question suggestion . Class 11 History Rastrer Prokriti Suggestion download Class 11th Question Paper History. WB Class 11 History suggestion and important question and answer. Class 11 Suggestion pdf.পশ্চিমবঙ্গ একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস পরীক্ষার সম্ভাব্য সাজেশন ও শেষ মুহূর্তের প্রশ্ন ও উত্তর ডাউনলোড। একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস পরীক্ষার জন্য সমস্ত রকম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তর।

Get the Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer by Bhugol Shiksha .com

Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer prepared by expert subject teachers. WB Class 11 History Suggestion with 100% Common in the Examination .

Class Eleven XI History Rastrer Prokriti Suggestion | West Bengal Council of Higher Secondary Education (WBCHSE) Class 11 Exam 

Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer, Suggestion Download PDF: West Bengal Council of Higher Secondary Education (WBCHSE) Class 11 Eleven XI History Suggestion is provided here. Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer Suggestion Questions Answers PDF Download Link in Free here.

রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর | Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer 

অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই ” রাষ্ট্রের প্রকৃতি (চতুর্থ অধ্যায়) একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর | Class 11 History Rastrer Prokriti Question and Answer ” পােস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই Bhugol Shiksha ওয়েবসাইটের পাশে থাকো যেকোনো প্ৰশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলাে করো এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তোলো , ধন্যবাদ।

WhatsApp Channel Follow Now
Telegram Channel Follow Now